শব্দার্থের অঙ্ক

শব্দার্থবিদ্যা যতটা ‘humanities’, ততটাই ‘natural science’-এর বিষয়। এই প্রকৃতিবিজ্ঞানের সর্বজনগ্রাহ্য রূপটি হল অঙ্কশাস্ত্র (গণিত নয়)। এবার উদাহরণ হিসেবে ১+২+৩...∞ -এই অসীম শ্রেণীটিকে নেওয়া যাক। শ্রেণীটির যোগফল যা হতে পারে বলে সাধারণ ভাবে মনে হয়, তা হল একটি সুবিশাল ধনাত্মক সংখ্যা (আদতে তাই-ই)। কিন্তু, শ্রীনিবাস রামানুজম দেখিয়েছেন এহেন শ্রেণীটি (-১/১২)-এ ‘অভিসৃত হতে’ (converge করতে) সক্ষম। এই আঙ্কিক বিষয়টি থেকে উপলব্ধ দর্শন হল, যে কোনও তরঙ্গ বা গতিশীল, সতত সঞ্চারণশীল স্বত্ত্বা (entity) কোনও না কোনও ভাবে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্থিরতা বা স্থিথিশীলতা প্রাপ্ত হয়। -যা কিনা এই ধরণের শ্রেণীর চেনাশোনা (প্রতীয়মান) চরিত্রকেও (ধনাত্মক) পুরোপুরি উল্টে দিতে পারে। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে একেই ‘জটিল সংগঠনে’র (complex system) সহজাত ‘বিভাজন বিন্দু’ (bifurcation point) বলে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘লোকটি কবি, ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফেলে দেয়।’... ধ্বনি, যা কিনা একটি তরঙ্গ, (যা আবার গতিশীল ও সতত সঞ্চারণশীল স্বত্ত্বা) আদতে একটি ‘জটিল সংগঠন’। আর তাই সহজাত গুণেই ভিন্ন ভিন্ন ‘বিভাজন বিন্দু’তে তা ভিন্ন ভিন্ন অর্থযুক্ত ক্রিয়া (শব্দ বা ‘word’) হিসেবে প্রকাশিত হয়। ঠিক যেমন পর্যায়ক্রমে তরঙ্গ (wave) থেকে কণার (particle), কণা থেকে ভরের (mass), ও ভর থেকে বস্তুর (matter) উদ্ভব হয়। -যা কিনা ক্রিয়ার, ক্রিয়াশীলতার ধর্মগুলিকেই সতত বয়ে চলে। সুতরাং, কোনও শব্দের অর্থ field বা ক্ষেত্রসাপেক্ষে (স্থান কাল পাত্রের ভিন্নতায়) পরিবর্তন তো বটেই, পুরোপুরি উল্টেও যেতে পারে। যেমন হিন্দির ‘আগে দেখিয়ে’ আর বাংলার ‘আগে দেখুন’ –এর অর্থ পুরোপুরি উল্টো। মাত্রা (dimension)-ভেদে ধ্বনির ব্যবহারিক অর্থ বদলে যায়। এই অর্থযুক্ত ধ্বনি বা শব্দগুলি মৌহূর্তিক অভিসরণ (momentary convergence) ছাড়া আর কী হতে পারে?

একবার ‘ফাজিল’ শব্দটিকেই ভেবে দেখা যাক, - আরবি আর উর্দুতে তার অর্থ ‘জ্ঞানী’, এদিকে বাংলায় তার অর্থ বাচাল, ফক্কড়। অনুমান করা যায় একটি স্থানে বা পাত্রের কাছে যা ছিল জ্ঞান, অপর স্থানে বা পাত্রের কাছে (যে কোনও কারণেই হো’ক) তা হল বাচলতা। আবার, যেমন বলা হয়েছে, কালের পরিবর্তনেও অর্থ যায় বদলে। ইংরেজির ‘nice’ ও ‘silly’ –শব্দদুটির অর্থ যেমন সময়ের সাথে একেবারেই উল্টে গিয়েছে। প্রাচীন ইংরেজিতে ‘nice’ শব্দটির অর্থ ছিল ‘foolish, stupid, senseless’ আর ‘silly’ শব্দটির অর্থ ছিল ‘happy, fortuitous, prosperous’! এই ক্ষেত্রে যা কিনা সময়ের সাথে দৃষ্টিভঙ্গী বদলের ইঙ্গিত। তবে মাথায় রাখতে হবে, এই বিভাজন বিন্দু বা bifurcation point-গুলির অস্তিত্বকে আপাতভাবে বিশৃঙ্খলা (chaos) মনে হলেও তারও কিন্তু নিয়মনিষ্ঠতা (স্ব-সংগঠন) আছে।...

যে কোনও ধরণের অভিসরণ (convergence) ছাড়া অসীমতাকে জানার বা বোঝার (to access) অন্য কোনও উপায় মানুষের হাতে নেই। সংগঠনের (stucture) ভিতরে ও বাইরে যেখানে সময়ও (time) অন্যতম চলক (variable) হলে তখন অভিসরণকেই আপাত-সত্য হিসাবে (অন্তত প্রাথমিক ধাপ হিসেবে) মেনে নিতেই হয়। বাকিটা সংগঠনের (system) আন্তরিক প্রবণতার ওপরে নির্ভর। সুতরাং ধ্বনির সঙ্গে অর্থের যুক্তি বা বিযুক্তি প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রবহমান তরঙ্গশ্রেণীর এক-একটি ‘অভিসরণ বিন্দু’ (converging point)।...

পৌরাণিক ‘ঘরওয়াপ্‌সি’


হিন্দুধর্মে এত জাতবিচার, শূদ্র বা দলিতদের প্রতি এত অবিচারের জন্য হামেশাই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যগুলিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু, সেটা কতদূর ঠিক? দেখা যাক;-

• ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। পূর্বে ব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পূর্ণ ছিল। তারা ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিযুক্ত বা প্রযুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র নামে অভিহিত হয়েছে। (মহাভারত শান্তিপর্ব, ১২.১৮৬.১০)
• পূর্বে ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পূর্ণ ছিল। তারাই বিভিন্ন পেশায় (কর্মে) নিযুক্ত হলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, ইত্যাদি বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। ‘তস্মাদ্বর্ণা ঋজবো জ্ঞাতিবর্ণাঃ’ – সমস্ত বর্ণই একে অপরের জ্ঞাতি। (শান্তিপর্ব ১৮৮-১০।)
• দেব, মুনি, দ্বিজ (দৈহিক জন্মের পর জ্ঞান অর্জন হেতু যার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে), রাজা (ক্ষত্রিয়?), বৈশ্য, শূদ্র, নিষাদ, পশু (‘যে অবিশেষে দেখে’, ত্রিসন্ধ্যাজপ ইত্যাদি পালন করে), ম্লেচ্ছ ও চাণ্ডাল (চণ্ডাল হইতে জাত) – এই দশ প্রকার ব্রাহ্মণ হয়। (৩৬৪ নং সূত্র, অত্রি সংহিতা।)
• অথর্ব্ব বেদে প্রার্থনা করা হয়েছে, -হে মানবজাতি, তোমাদের জলগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ একসাথে হো’ক। (অথর্ব্ববেদ ৩.৩০.৬)
• আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র অনুসারে, আর্য্যাদের তত্ত্বাবধানে শূদ্রের রান্না করাই নিয়ম। (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ২.২.৩.৪)
আসলে বৌদ্ধযুগের পতনের পর বৈদিকধর্মের ব্যাপক restructuring করে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সৃষ্টি করার সময় বৈদিকধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বাদ দিয়ে, জন্মগত জাতিভেদ প্রথা চালু করে সামাজিক hegemony-কে পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। -যাতে সমাজের শৃঙ্খলাটা বেশ কড়া হাতে ধরে রেখে সম্ভাব্য কোনও ‘দ্বিতীয় বৌদ্ধযুগে’র আগমণ ঠেকানো যায়।

হ্যাঁ, বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের আক্রোশ কিছুটা বেশিই ছিল। নারদপুরাণে বলা হয়েছে, নিজের চরমতম বিপদের দিনেও যদি ব্রাহ্মণ কোনও বৌদ্ধের বাড়িতে প্রবেশ করে, তাহলে কয়েক শো বার প্রায়শ্চিত্তেও তার নিস্তার নেই। (নারদ পুরাণ ১.১.১৫.৫০) এই পরিমাণ ভয় দেখিয়েও যখন শেষরক্ষা হল না, তখন গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর ‘নবম অবতার’ হিসেব প্রচার শুরু হয়েছিল!

মহাভারতের শল্যপর্বে একটি অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনও এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় সারস্বত মুনির নেতৃত্বে গোমতী নদীর তীরে অন্নসত্র খুলে, খাদ্যের ‘বিনিময়ে’ প্রায় ষাট থেকে চৌষট্টি হাজার বৌদ্ধকে বেদপাঠ শুনিয়ে, পৈতে পরিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল।

মহাভারতে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে। কিন্তু, অতিপ্রাচীনকালে রচিত বলে একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও মহাভারত ‘লেখা’ হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ, মৌর্য্যযুগে। (সূত্র: ‘সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ’ – পরেশচন্দ্র মজুমদার) ঘটনাচক্রে, মহাভারতের ভাষাতেও অভিজাত সংস্কৃতের পরিবর্তে প্রাকৃত ও ‘মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃত’ ভাষার প্রভাব বেশি। অবশ্য মহাভারতের অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্করণগুলিতে এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’র ঘটনাটি বৌদ্ধদের পরিবর্তে ‘বেদজ্ঞান বিস্মৃত’দের সাথে ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু মহাভারত নয়, ভবিষ্যপুরাণেও এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’ বা ধর্মান্তকরণের উল্লেখ আছে। এই পুরাণটির রচনাকাল ষষ্ট শতাব্দীর প্রথমভাগের আগে নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে ‘মরুস্থলে’ (মেরুস্থলে বা মেরুপ্রদেশে নয়) ‘মহামদ’ (মহম্মদ?) নামের এক ‘শিষ্যশাখা’ (সাহাবি?) সহ বিরাজ করার কথা বা মরুস্থলের রাজা ও নিবাসীরা সেই মহাদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার কথা বলা আছে। (ভবিষ্যপুরাণ, ৩.৩.৩.৫-৬। যদিও গোরক্ষপুর গীতাপ্রেসের ভবিষ্যপুরাণের হিন্দি অনুবাদে এই শ্লোকদুটির উল্লেখ থাকলেও তাদেরকে অনেকটাই ‘ভিন্নার্থে’ ব্যখ্যা করা হয়েছে।)
যাই হোক, ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে মহর্ষি কর্ণের চেষ্টায় ‘মিশ্রদেশ’ বা মিশর থেকে উদ্ভূত কশ্যপগোত্রের ‘ম্লেচ্ছ’রাও বেদ পাঠ, শিখা ও উপবিত ধারণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যধর্মে পুনঃপ্রবেশ করে। (ভবিষ্যপুরাণ, প্রতিসর্গ ৪.২১)।

ওপরের অনুচ্ছেদটি পড়ে দুটি খটকা জাগতে পারে। এক, ম্লেচ্ছদের ‘কশ্যপ গোত্র’ বলা হচ্ছে কেন? ও দুই, ‘মিশ্রদেশ’কে ‘মিশর’ ভেবে বসা কতটা যুক্তিযুক্ত?

প্রথমতঃ, ম্লেচ্ছ শব্দের বর্তমান অর্থ যাই হোক না কেন, যাবতীয় শূদ্র ও ‘অব্যক্তভাষী’ (যে সংস্কৃতে কথা বলে না) মানুষকেই ম্লেচ্ছ বলা হত। হরিবংশপুরাণ ও মনুসংহিতা অনুসারে ‘বদাচারবহিষ্কৃত’ ও মেদিনীকোষ অনুসারে ‘বেদবাহ্য দুরাচার’ মাত্রেই ম্লেচ্ছ। আর কে জানে, শূদ্রেরই বেদপাঠ নিষিদ্ধ ছিল। আর ‘শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে’র ‘প্রাণতোষী’ অধ্যায়ের ‘হর-পার্বতী সংবাদ’ অংশ অনুসারে শূদ্রজনের গোত্র হল কশ্যপ।

(এই ‘হর-পার্বতী’র কথোপকথনের মাধ্যমে দেশের পঁচাশি শতাংশ মানুষের গোত্র পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার ঘটনা থেকেই ‘হরে দরে কশ্যপ গোত্র’ –প্রবাদটির উৎস। অবশ্য কশ্যপগোত্রের মানুষজন বহুক্ষেত্রেই মানসম্মান কম পেয়েছেন, কশ্যপপত্নী সরমার প্রিয়পাত্রদের বা ‘সারমেয়’দের তো কুকুরের সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়!)

রইল পড়ে ‘মিশ্রদেশ’ রহস্য। সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলাভাষায় মিশরকেই মিশ্রদেশ বলা হত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯০৯ সালে প্রকাশিত সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ভারতে অলিকসন্দর’ (আলেকজ়ান্ডার) নামক বইয়ের একটি অংশে দেখা যায়, সেখানে আলেকজ়ান্ডার বলছেন, ‘...ফিনিসীয় নৌশক্তির সাহায্যে, আমরা সামুদ্রিক আধিপত্য লাভ করিতে সমর্থ হইব। তখন মিশ্রদেশ অধিকার আমাদের সহজসাধ্য হইবে। মিশ্রদেশ বিজয়ের পর গ্রীসের বা আমাদের দেশের ভাবনা আর ভাবিতে হইবে না।...’

যাই হোক, ঘরওয়াপ্‌সি-তে ‘ওয়াপ্‌স’ আসা যাক। এই বিষয়ে সমস্ত উদ্যোগকে ছাপিয়ে গিয়ে ছিল আদি শঙ্করাচার্য্য। আনন্দগিরির ‘শঙ্করদিগ্বিজয়’, চিদ্ধিলাস যতির ‘শঙ্করবিজয়’, ব্রহ্মানন্দের ‘লবুশঙ্করবিজয়’, তিরুমল্প দীক্ষিতের ‘শঙ্করাচ্যুদয়’, ইত্যাদি গ্রন্থের কিংবদন্তি অনুসারে অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারত, মধ্যভারত ও দাক্ষ্যিণাত্যে কয়েক কোটিরও বেশি ‘বিকৃত’ বৌদ্ধকে ব্রাহ্মণ্যধর্মে ফিরিয়ে আনেন! তবে বাংলা সহ পূর্বভারতে এর প্রভাব তেমনভাবে পড়ে নি। শশাঙ্কের শাসনকালে (৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের আনাগোনা শুরু হলেও আঠারো পুরুষ ধরে চলা পাল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় বৌদ্ধধর্ম টিকে ছিল বহাল তবিয়তেই। বরং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মে ‘যৌথ প্রভাবে’ তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ (যাঁরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ক্ষত্রিয়ের পেশা গ্রহণ করেন) সেন রাজবংশের আমলে বৌদ্ধ, তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মিলেমিশে এক ‘পৃথক হিন্দুধর্মে’র সৃষ্টি হয়। (হয়তো সেই কারণেই আজও বাঙালি হিন্দু ও উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে আচার আচরণে বেশ কিছু তফাৎ থেকেই গিয়েছে।) কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে কৌলিণ্যপ্রথা ও বিভিন্ন রাজ অনুগ্রহের কারণে যে সেনবংশের দৌলতে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, পশুপতি মিশ্র নামের এক ব্রাহ্মণই এগারো লক্ষ টাকার ঘুষের বিনিময়ে বখতিয়ার খলজীর হতে সেনবংশের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেনযুগের পর সুলতানি শাসনকালে বাংলার ‘মুণ্ডিতমস্তক’ (ন্যাড়া) বৌদ্ধদের অপরাংশ পরিণত হয় ‘নেড়ে মুসলমানে’।

সতীর কথা


সতী = ‘সত’-এর ভাব সক্রিয় (ই) যাহাতে। - যে জনগণ সামাজিক/ প্রাতিষ্ঠানিক আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলে (বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ)। আইন-শৃঙ্খলার ‘মৃত্যু’ হলেই ‘সতী’দের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তারা ভেতরে ভেতরে ‘জ্বলে-পুড়ে মরে’। -এই হল ‘সতীদাহ’। বাইরে থেকে গায়ে আগুন দিতে হয় না!

আসলে, পণ্যের উৎপাদন শুরু হওয়ার বহু আগেই এই ভূখণ্ডের মানুষ ‘পরিচালক ও পরিচালিত’ (‘শিব ও সতী’) –এই দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে পরেছিল। (‘In the primitive Indian community there is social division of labour, without production of commodities.’ - Section 2, Capital, Volume 1. –Karl Marx) ফলে, পরিচালকের অনুপস্থিতিতে পরিচালিতের অস্তিত্ব বিঘ্নিত হত। বিষয়টি সহজ করে বোঝার জন্য উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, রামবাবু ‘ক’ প্রতিষ্ঠানে কেরানির পদে কর্মরত। সুতরাং ক-নামক প্রতিষ্ঠানটি এখানে পরিচালক বা শিব আর রামবাবুর ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটি হল পরিচালিত বা সতী। এখন ক-নামক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হলে (মৃত্যু ঘটলে) একই সাথে রামবাবুর ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটির মৃত্যু ঘটে। ব্যাক্তি রামবাবু তারপর ‘খ’ প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতেই পারেন, কিন্তু তাহলেও তার ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটি পুনর্জীবিত হয় না। (আর যেহেতু সচ্চরিত্রের মহিলার মধ্যেও ‘সৎ-এর ভাব সক্রিয়’, তাই সে-ও সতী।)

এবার রইল বাকি ‘সহমরণ’ অর্থে সতীদাহের প্রসঙ্গ; -এর প্রথম ও প্রধান কারণ ছিল বিধবার সম্পত্তি হরণ ও তার দায়-দায়িত্ব বর্জন। এছাড়াও (রামমোহন রায়ের ভাষায়) ‘...লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সহমরণ করিলে এ আশঙ্কা থাকে না...’। ঋগ্বেদের যে শ্লোকটিকে (১০.১৮.৭) এককালের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ সহমরণের সপক্ষে ব্যবহার করত, সেটি হল, ‘ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা সং বিশন্তু। অনশ্রবোহনমীবাঃ সুরত্না আরোহন্তু জনয়ঃ যোনিমগ্রে॥’ আসলে যার অর্থ হল, ‘এ সকল নারী বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করে, মনোমত পতিলাভ করে অঞ্জন ও ঘৃতের সাথে গৃহে প্রবেশ করুন। এ সকল বধূ অশ্রুপাত না করে, রোগে কাতর না হয়ে উত্তম উত্তম রত্নধারণ করে সর্বাগ্রে গৃহে আসুন।’ (অনুবাদ: রমেশচন্দ্র দত্ত) কিন্তু, এই শ্লোকটির ‘আরোহন্তু জনয়ঃ যোনিমগ্রে’ –অংশের ‘যোনিমগ্রে’ (বা যোনিং অগ্রে) শব্দটিকে ‘যোনিমগ্নেঃ’ (বা যোনিং অগ্নেঃ) হিসেবে পাঠ করে (বিকৃত করে) সহমরণের পৃষ্ঠপোষকেরা প্রথাটিকে ‘বেদসম্মত’ ঘোষণা করেছিল!

ঘটনাচক্রে, ঋগ্বেদে এর পরের শ্লোকটিই (১০.১৮.৮) হল, ‘উদীর্ষ্ব নার্ষভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।...’ যার অর্থ, নারী তুমি সংসারে ফিরে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ সে মৃত।... পরের লাইনে ‘সংসারে ফিরে চলতে’ বলা হলে তার আগের লাইনে কোনও যুক্ততেই ‘আগুনে পুড়ে মরার’ আদেশ থাকতে পারে না। এমনকি অথর্ববেদেও (১৮.৩.১.১) ‘জীবলোকের উদ্দেশ্যে মৃত পতির পাশ থেকে উঠে আসতে’ বলা হয়েছে (উদীষর্ব নার্যভি জীবলোকং গত্যসুমেতমুপ শেষ এহি)। একশ্রেণীর লোকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য শতকের পর শতক একটি কুপ্রথার লাগাতার গুণগান ও মগজধোলাই চালিয়ে যাওয়ার ফলে বলপ্রয়োগে সতীদাহের পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের স্বেচ্ছায় সহমরণের উদাহরণও অবশ্য পাওয়া যায়। (ঠিক যেমন তথাকথিত ধর্মের বা আদর্শের জিগির তুলে পর্যাপ্ত মগজধোলাই করার ফলে আজও কিছু মানুষ আত্মঘাতী সেনাদলে নাম লেখায়।)

অবশ্য মনুসংহিতা, ব্যাসসংহিতা, অত্রিসংহিতা, ইত্যাদি আইনগ্রন্থে সহমরণের প্রথাকে বেশ ভাল রকম গৌরবান্বিত করা হয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার ‘হিন্দু প্রতিক্রিয়া যুগে’, অর্থাৎ মৌর্য্যযুগের পতনের পর জন্মগত ব্রাহ্মণত্ব ও পুরুষতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এই আইনগ্রন্থগুলির ব্যাপক ‘সংশোধন’ করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা ‘স্বয়ম্ভূ মনু’ কতৃক রচিত বলে ওই দাবী করা হলেও তার যে সংস্করণটি প্রচলিত, সেটিকে রচনা করেছিল সুমতি ভার্গব নামের এক ব্রাহ্মণ, ১৭০-১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, পুষ্যমিত্র শুঙ্গের আমলে। (সূত্র: ‘নারদস্মৃতি’, সম্পাদনা ও অনুবাদ নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ।) আসলে পুষ্যমিত্র মৌর্য্য (বৌদ্ধ) সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠা করার পর বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এবং পুরোনো ধর্মশাস্ত্রকে বাতিল করে দিয়ে বর্ণব্যবস্থাকে জন্মগত বানিয়ে ব্রাহ্মণকে সবার ওপরের আসনে বসাতে এই গ্রন্থ রাজ অনুগ্রহে রচিত হয়। যার কয়েক পাতা ওল্টালেই বোঝা যায়, নারীর চরিত্র বিষয়ে সে সময়ের সমাজকর্তাদের আশঙ্কার শেষ ছিল না! কিন্তু, এমন নির্লজ্জ একচোখামির দরকার পড়ল কেন???

আর্য্য

বিদেশী পণ্ডিত ও (বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত) কিছু ভারতীয় পণ্ডিতের সৌজন্যে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস আজও এক গোলকধাঁধা। সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক বা আর্য্য (‘আর্য’ নয়) সভ্যতার ইতিহাসকেই দেখা যাক। বলা হল, সিন্ধু সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল, সেই তুলনায় ‘বহিরাগত’ আর্য্যরা নাকি ছিল অনুন্নত। প্রথমটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা, আর আর্য্যরা নগর বিরোধী। বলা হল, আর্য্যদের ঝটিকা আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়। আর এই সম্পূর্ণ বিভাজনের অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসেবে ইতিহাসবিদদের মনে রইল -ঘোড়ার ব্যাবহার জানা আর না জানা। দুঃখজনক ভাবে গোটা বিশ্লেষণটিই পরস্পর বিরোধিতায় পূর্ণ। ভেবে দেখুন না, দারুণ উন্নত সিন্ধুসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, স্নানাগার, ইত্যাদি পাওয়া গেল অথচ কিছু দুর্বোধ্য লিপি ছাড়া একটিও সাহিত্যকীর্তি পাওয়া গেল না! আর বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত যাদের রচনা, -সেই আর্য্যরা নাকি ‘অনুন্নত’! তারা নাকি নগর বিরোধী ছিল, অথচ তাদের রচনায় অযোধ্যা, হস্তিনাপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, দ্বারকা, ইত্যাদি নগরের (কাল্পনিক ধরলেও) বর্ণনা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত। এমনকি বেদেও নগর-মহত্বের উদাহরণ নেহাৎ কম নয়।....
এরপরেও আর্য্যদের তথাকথিত নগর-বিরোধীতার প্রসঙ্গ উঠলে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের ঢঙে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, -এটা যদি বেড়াল হয়, তাহলে মাংস কোথায়? আর এটা যদি মাংস হয়, তাহলে বেড়াল কোথায়!? আসলে সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক সভ্যতাকে গোড়াতেই আলাদা ধরে নেওয়ার পর যখন বৈদিক সভ্যতার কোনও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেল না, তখন জবরদস্তি তাকে গ্রামীণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। নইলে একদিকে যে জাতিকে পৃথিবীর প্রায় সবকটি উন্নত সভ্যতার জনক বলা হয়, তারা কখনও নগর বিরোধী হতে পারে?
ভৃত্যের জ্ঞান, ইতিহাস বা ঐতিহ্য প্রভুর থেকে মহানতর হলে প্রভু তা কোনওদিনই মেনে নেয় না। এদেশের একদা প্রভুরা এদেশের ইতিহাস লেখার সময় তার যথেষ্টই পরিচয় রেখেছেন। বস্তুতঃ, আর্য্য আগমন তত্ত্বের বিপক্ষে সহস্রাধিক প্রমাণ ও শতাধিক গ্রন্থ আছে। পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের সমাধি আবিষ্কার হলে দেখা যায় সেখানে তার পরিচয় হিসেবে লেখা আছে ‘একজন পারসীক, একজন পারসীকের পুত্র, একজন আর্য্য, আর্য্যবংশোদ্ভূত’। -আর্য্য আগমন তত্ত্বে এ ছিল একটি বড়ো ধাক্কা। হাল আমলের গবেষকরাও এই তত্ত্বকে নাকচ করেছেন। যদিও মেক্‌ল সাহেবের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার গুণে বহু ভারতীয় আজও সত্যটি মানতে চান না।
‘আর্য্য’ শব্দটি জাতিবাচক নয়, গুণবাচক। ঋগ্বেদ (১.৫১.৮) অনুসারে এর অর্থ ‘বিদ্বান্, অনুষ্ঠাতা’। অমরকোষ টিকা অনুসারে এর অর্থ ‘উপজীব্যতা হেতু উপগম্য’। সহজ করে বললে, জীবিকার জোরে সমাজের উপরিভাগে উঠে আসা মানুষজন। (আজকের সমাজের সাপেক্ষে অফিসের মেজবাবু ছোটবাবুর থেকে বেশি আর্য্য, আবার বড়বাবু মেজবাবুর থেকে বেশি আর্য্য।) এই ‘আর্য্য’ থেকে ‘আয্যি’, আর ‘আয্যি’ থেকেই সন্মানীয় ব্যক্তিদের নাম বা সম্বোধনের শেষে ‘জী’ যুক্ত করার রীতি। (সূত্র: Indigenous Indians: Agastya to Ambedkar by Koenraad Elst)
এরপর, ‘আর্য্য আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতার পতনে’র কথা। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত তেত্রিশ বা সাইত্রিশটি কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে ইতিহাসকার হুইলার সাহেব সর্বপ্রথম এই গুজবটি রটিয়েছিলেন। মহেঞ্জোদারোর আয়তন প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ বর্গ ফুট, সেখানে বাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ হাজার। এর জনসংখ্যা ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজারের মধ্যে। (তথ্যসূত্র: Deptt of Archaeology and Museums, Govt of Pakistan, Oxford University ও National Geographic) সেখানে মাত্র গোটা তিরিশেক কঙ্কাল কোন যুক্তিতে ‘large scale destruction and abolition of Indus Valley Civilisation’-এর প্রমাণ হয়ে ওঠে, -তা সত্যিই বিস্ময়কর। (‘জামা কিনিতে গেলাম, পাইলাম একপাটি মোজা; এখন ভাবিতেছি, ঐটেকেই কাটিয়া ছাঁটিয়া কোনোমতে জামা করিয়া পরিব।’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)
এবার রইল পড়ে ঘোড়ার ব্যবহার জানা আর না জানা। যেহেতু বৈদিক সাহিত্যে অশ্বের উল্লেখ আছে, আর সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যায় নি, তাই ‘ঘোড়ার ব্যবহার’কে দুই সভ্যতার বিভাজন রেখা ধরে বসা হল। কিন্তু, বৈদিক সাহিত্যে তো দেবতা, অসুর, দৈত্য, দানব, হস্তপদবিশিষ্ট নাগ, গরুড় পক্ষী, ছাগমুণ্ড দক্ষ, যক্ষ, রাক্ষস, কিন্নর, গন্ধর্ব, পারিজাত পুষ্প –এদেরও উল্লেখ আছে এবং তাদের কারুর-ই জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি (পাওয়ার কথাও নয়)! এদিকে গুজরাতের সুরকোডাটায় সিন্ধু সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক সাইটে ঘোড়ার কঙ্কাল পাওয়া যাওয়ায় ‘অশ্বের ব্যবহার’-তত্ত্বেও দুলুনি লেগেছে বইকি।
সাম্প্রতিক কালে সরস্বতী নদীর প্রাচীন গতিপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা গেছে তথাকথিত ‘সিন্ধু সভ্যতা’র আজ অবধি আবিষ্কৃত কম-বেশি ২৬০০ পুরাতাত্ত্বিক স্থানের প্রায় ২০০০টির অবস্থান সিন্ধু নয়, সরস্বতী নদীখাত বরাবর। কিন্তু, আজও একদল পণ্ডিত (দেশিদের মধ্যে হাবিব, থাপার, প্রমুখ) সরস্বতী নদীর অস্তিত্বই স্বীকার করেন না, বলেন –এই নদী নাকি একটি বৈদিক কল্পনা মাত্র! কিন্তু, ১৯৮০ সালে আমেরিকার ল্যান্ডস্যাট ও ১৯৮৪ সালে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের আই. আর. এস. ১ সি. উপগ্রহ-চিত্রে সরস্বতী নদীখাত চিহ্নিত হয়। নদীটি হিমালয়ের বন্দরপুছ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিয়ানার আদিবদরী, রাখিগিরহি (‘সিন্ধু’ সভ্যতার বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট) হয়ে আরাবল্লির পশ্চিম দিক দিয়ে রাজস্থানের কালীবঙ্গান, পাকিস্তানের নওয়াকোট হয়ে কচ্ছের রণে এসে আরবসাগরে মিশেছিল। মোটামুটি ১৮০০-১১০০ খ্রী.পূ. –এর মধ্যে কোনও এক সময়ে ভূমিকম্পে আরাবল্লি ও হিমালয়ের plate-shifting হয়। এর ফলে নদীটিকে পুষ্টকারী জলধারাগুলি (যমুনা, সুপিন, রুপিন, টনস, ইত্যাদি) গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নদীটি ক্রমশঃ শুকিয়ে যায়। থর মরুভূমির সৃষ্টি হয়। ১৯৯৭ সাল নাগাদ ভারত সরকার এই শুকনো নদীখাত বরাবর ২৪টি নলকূপ খোঁড়ে। ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টার এই নলকূপের জলের আইসোটোপিক পরীক্ষা করে জানায় –সেই জলের উৎস হিমালয় পর্বত। (সূত্র: January 1998 issue of ‘Current Science’ journal, Journal of Indian Society of Remote Sensing)... রাজস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হ্রদগুলির জল ও তার তলদেশের পাথর-ও হিমালয়ের সন্তান। সুতরাং, এই প্রশ্ন-ও উঠতেই পারে, -সিন্ধু সভ্যতা ঠিক কতটা শুধুমাত্র ‘সিন্ধু সভ্যতা’?... এর পাশাপাশি ঋগ্বেদ জুড়ে নদী সরস্বতীর বন্দনাকে বিবেচনা করলে বোঝা যায় -দুটি সভ্যতা আসলে একই।

সোমরস বা বণিকপুঁজি

ঋগ্বেদে কয়েকশো (হাজার-ও হতে পারে) বার প্রভুত্বকারী বা ইন্দ্র-সত্তার সোমরস-প্রেমের কথা বা তাকে সোমরস উৎসর্গ করার নির্দেশ পাওয়া যায়। (‘সোম’ শব্দের একটি অর্থ ‘চন্দ্র’) সোমরস মাদকতা আনে। প্রভুত্বকারীর মাদকতা কিসে হয়? –প্রভুত্বে বা ব্যক্তিমালিকানায়। (ইন্দ্র বিরোধী জরাথুস্ট্রীয়রা ‘হাওমা’ বা সোম-পানের বিরোধী।) বেদে ‘সোম’ সোমরস। কিন্তু, বাণিজ্যতন্ত্রের যুগে ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের সাথে সাথে এই সোম ‘চন্দ্রদেবতা’ হিসেবে উল্লেখিত হতে থাকেন। চন্দ্রের ষোলটি কলা। দেখা যাক কী কী ;-
• অমৃতা : অমরত্ব দানকারী ‘অমৃতে’র ‘আধার’ (আ)। মনুসংহিতা অনুসারে যজ্ঞশেষের পুরোডাশ বা পিঠে (কর্মযজ্ঞের ফলে উৎপন্ন পণ্য), ধন, ঘৃত, অন্ন, বিষমাত্র, সুরা, অতিবিষ, ইত্যাদি। (বণিকের নাম ‘অমরত্ব’ পায় তার পণ্য, সম্পদ, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, brand name-এর মাধ্যমে।)
• মানদা : মান দান করে যা/ যে। কৌলীন্য, পরিমাপ, গোঁসা/ গুমোর, ইত্যাদি দান করে যা/ যে।
• পূষা : ‘পূষ’-এর (প্রদানকারীর দিশাগ্রস্ত শক্তির) আধার (আ)। (‘পূষ’ থেকে ‘পোষণ’ বা আধুনিক ‘পোষা’) ধনসম্পদ বা জ্ঞানসম্পদের কেন্দ্র।
• তুষ্টি : সন্তোষ বা প্রীতির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• পুষ্টি : সম্পূর্ণতা, সন্তুষ্টি, পূর্ণতা, ইত্যাদির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• রতি : রত + ই (সক্রিয়ন)। কর্মে নিযুক্ত/ লিপ্ত/ অর্পিত (invested) বা ‘রত’ হওয়া। (স্মর্তব্য: আরতি, বিরতি, অবিরত, কর্মরত, ইত্যাদি শব্দগুলি।)
• ধৃতি : সুখ, আশ্রয়, শরণ, ব্যভিচারভাব বিশেষ। মানসিকতার বন্দিত্বের (ধৃত) সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• শশিনী : ‘শশ-গুণ’ বা দ্রুত/ আকস্মিক/ (লাফিয়ে লাফিয়ে) আকার বৃদ্ধির/ হ্রাসের গুণ সক্রিয় যা’তে। (‘শশক বা খরগোশের চিহ্ন বুকে ধারণ করে বলে চাঁদের আরেক নাম শশধর’, -এই জবরদস্তি ব্যাখ্যাটি আধুনিক যুগের সংযোজন। চাঁদের পিঠে আলো-ছায়ার খেলাকে শুধু খরগোশ কেন, আরও অনেক কিছুর-ই আবয়ব হিসেবে কল্পনা করা যায়। আশৈশব ‘চাঁদের বুড়ি’র গল্প শোনানোর পর, একমাত্র এই ‘শশধর’ শব্দটির ন্যায্যতা ‘প্রমাণ’ করার সময় সেই বুড়ি হঠাৎ খরগোশে পরিণত হয়!)
• চন্দ্রিকা : আনন্দদায়িনী, বিশদব্যাখ্যা, ইত্যাদি।
• কান্তি : ‘কান্ত’ (কাম তাড়িত হয় যা’তে বা যা’কে সবাই কামনা করে) –এর সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• জ্যোৎস্না : জ্যোতির্যুক্ত কাল। নিজস্ব নয়, ‘-জনিত’ বা প্রতিফলিত আলো।
• শ্রী : অভ্যুদয়, বৃদ্ধি, উদয়, ঐশ্বর্য্য, প্রভুভাব, অধিকার, ইত্যাদির প্রকাশ।
• প্রীতি : তৃপ্তি, আমোদ, প্রেমভাব, ইত্যাদির প্রকাশ।
• অক্ষদা : ‘অক্ষ’ দান করে যা/ যে। অক্ষ = যা ব্যাপ্ত করে।
• পূর্ণা : ‘পূর্ণ’ (আরক্তি, সামগ্রিকতা, আকর্ষণ, ইত্যাদি) -এর আধার (আ)।
• পূর্ণামৃতা : পূর্ণ + অমৃতা, বা ‘অমৃতা’-কলার পূর্ণ রূপ/ ভাব।
একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চন্দ্রের ষোলটি কলা ব্যক্তি-পুঁজির বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট-বাচক। উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে মধ্যবিত্তের আতঙ্ক উদ্রেককারী শব্দ ‘চাঁদা’ -এর দিকে খেয়াল করলেই ব্যক্তি-পুঁজির সাথে ‘চাঁদে’র সম্পর্ক হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যায়! বহুক্ষেত্রেই এই অনুষ্ঠানগুলি সম্পন্ন করা হয় ‘চন্দ্রাতপ’ বা ‘চাঁদোয়া’র তলায়। [চন্দ্র > চন্দা > চাঁদ। অবশ্য অনেকের মত বাংলাভাষায় ‘চাঁদা’ শব্দটি এসেছে ফার্সি ‘চন্দহ্’ শব্দ থেকে। হতেই পারে। কারণ, আবেস্তান (প্রাচীন ফার্সি) ও বৈদিক ছান্দস ভাষা নিকটাত্মীয়।] পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের আতপ বা রৌদ্র থাকে না। এই প্রথার তাৎপর্য হল –ব্যক্তি পুঁজির ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। যাই হোক, আদিতে এই ব্যক্তি-পুঁজির কারবারীরা নিজের নামে ‘চাঁদ’ বা ‘চন্দ্র’ শব্দগুলি প্রয়োগ করত। (স্মর্তব্য: ‘চাঁদ সদাগর’ নামটি।) ‘প্রচলিত প্রথার বিপরীতে চললে’ বা ‘বামন’ হলে ব্যক্তি-পুঁজির বা বণিক-পুঁজির নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু, শেয়াল/ শিয়াল/ শৃগাল অপরের শিকার বা পরিশ্রম লব্ধ ফল অপহরণ করতে অভ্যস্ত। (সম্ভবতঃ ‘মাখন চুরি’ ও কূটবুদ্ধির কারণে) পৌরাণিক ভাষায় স্বয়ং বাসুদেবকেই শৃগাল বলা হয়েছে! (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ, সারস্বতাভিধান, শব্দকল্পদ্রুম) শৃগাল ফিরে ফিরে চুরি করে। স্বভাববশতঃ, সে ‘চাঁদ উঠলে’ (ব্যক্তি/ বণিক পুঁজির উদয় হলে) হাঁকডাক শুরু করে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্যক্তি পুঁজিকেই বণিক পুঁজি বলা হচ্ছে কেন? –পুঁজির উৎসের কারণে। বিক্রয়যোগ্য বিষয়টি ‘পণ্য’ই হোক কি ‘শ্রম’ অথবা ‘মেধা’, পুঁজি উপার্জনের সময় কোনও না কোনও রূপে যে কর্মটি সম্পাদন হচ্ছে তা হল বাণিজ্য। এমনকি আজও যার শ্রম আছে -সে শ্রম বিক্রি করে, যার মেধা আছে -সে বিক্রি করে মেধা আর বাকিরা বিক্রি করে এই দুই পক্ষের শ্রম ও মেধার প্রয়োগে উৎপাদিত পণ্য।
(প্রসঙ্গতঃ বলি, পুঁজ ও পুঁজি, -শব্দদুটির উৎস একই। চাষীর ভাগের ধান জোতদার বা জমিদারের খামারে জমে থাকলে তাকে ‘পুঁজ’ বলা হয়। ১৯৪৬-৪৭-এর তেভাগা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ছিল ‘পুঁজ ভাঙা আন্দোলন’।)

অশ্বমেধ ও ঘোড়ার মাথা

বৈদিক রচনায় ঘোড়াবা ঘোটকনেই, আছে অশ্ববেদের বুৎপত্তি গ্রন্থ নিরুক্ত। সেই নিরুক্ত বলে, -‘ব্যাপ্ত্যর্থক অশ্ ধাতুর উত্তর ক্কন্ প্রত্যয়ে অশ্ব শব্দের নিষ্পত্তি। অশ্ব নাম কোথা থেকে হল? অশ্ব পথ ব্যাপ্ত করে। অশ্ব মহাভোজন হয়। অশ্ব চলনপটু হয়। অশ্ব পথের কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। অশ্ব নিজের আকৃতির দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। অশ্ব চালকের প্রজ্ঞা বর্ধিত করে।’ –এখানে একবারের জন্যও ঘোটক বা কোনও ইতর জীবের ইঙ্গিত নেই, আছে কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সংকলন। বাংলায় অশ্বশব্দের আরেকটি অর্থ পাওয়া যায়, -‘চার জাতি পুরুষের চতুর্থজাতি’! –অশ্ব তাহলে পুরুষ! কিন্তু, এ কেমন পুরুষ’? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অথর্ব্ববেদে (১২.৪.৭) কিশোরশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মানব-অশ্বগণের সন্তানঅর্থে। দেখা যাচ্ছে, ‘কিশোরশব্দটির বর্তমান অর্থে তেমন কিছু পরিবর্তন হয় নি। (তবে আজকের যুগধর্মের প্রকোপে কিশোর’-কুল কেন যে ইঁদুরদৌড়েসামিল হয়েছে, – তার সদুত্তর অবশ্য কোনও অভিধানে মিলবে না!)

অশ্ব = অশ্ + ব। অর্থাৎ অশ্বা প্রাপ্তি, উপভোগ, লাভ, ব্যাপ্তি, রাশীকরণ (রাশ করা, পুঞ্জীকরণ) ইত্যাদির ক্রিয়ার বহনকারী’ (ব)। সহজ করে বললে, ‘অশ্ববিশেষজ্ঞ ও উঁচু পদের কূটনীতিকগণ, -যারা বুদ্ধির জোরে কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। সে তার কৃতকর্মের আকার (আকৃতি) দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। পরামর্শের মাধ্যমে চালকের (রাজার) প্রজ্ঞা বর্ধিত করে। সংঘাত বা কূটনীতির মাধ্যমে পররাজ্য গ্রাস করে, স্বরাজ্যের রাজকোষে ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত করে, রাজ্যের সীমা ব্যাপ্ত করে, ইত্যাদি। এই কর্মকাণ্ডকে অশ্বমেধ যজ্ঞবলে। আর যেহেতু ঘোড়ার মধ্যেও আতিভোজন, চলনপটুতা, ইত্যাদি গুণ দেখা যায়, তাই সেই প্রাণীকেও অশ্বনাম দেওয়া হয়।

আন্দাজ করা যায়, যেহেতু রোমান, আইরিশ ও নর্স (জার্মান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান) জাতিগুলির মধ্যে ঘোড়া বলি দেওয়ার ও তার মাংস ভক্ষণের প্রথা ছিল, তাই এই ইতিহাসে অভিজ্ঞ ইউরোপীয় পন্ডিতেরা অশ্বমেধ যজ্ঞ’-এর উল্লেখ পাওয়া মাত্র তাকে ঘোড়া বলিদাগিয়েছিলেন। আর এই ধারণায় সার-জল জুগিয়েছিল তাদের আর্য্য আগমন তত্ত্ব’! অশ্বমেধ প্রসঙ্গে অনেকে যজুর্বেদে অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনার কথাও তোলেন। কিন্তু, সেই মতে যজ্ঞের উপযুক্ত অশ্ব’-এর বয়স চব্বিশ থেকে একশ বছর! ঘোড়ার গড় আয়ু যেখানে কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর, সেখানে এই অশ্ব মানবপ্রজাতির তরুণ, প্রতিভাশালী অথবা অভিজ্ঞ কূটনীতিক, কোনও ভাবেই চারপেয়ে জন্তু নয়। এছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে, অশ্ব হল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। (রাজা সুশাসক হলে রাষ্ট্র বেগবান হয়, রাজকোষ ধনসম্পদে পূর্ণ হয়, তার আকার বা প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্য রাজাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে, পররাজ্য বিজিত হয়, ইত্যাদি। - নিরুক্ত অনুসারে যেগুলি অশ্বধর্ম।) এমন রাষ্ট্রের কামনায় বুদ্ধিনিষেক বা মেধাপ্রয়োগ করে যে কর্মযজ্ঞের আয়োজন করা হয়, তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞবলা হয়। (মেধথেকে মেধাশব্দটি সৃষ্টি হয়েছে।) ঘটনাচক্রে, ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তেই বলা হয়েছে, যজ্ঞ হল অহিংস। আর মেধশব্দটির অর্থ হত্যাহলে শুক্ল যজুর্বেদের মাধ্যন্দিন শাখার বাজসনেয়ী সংহিতায় যে সর্ব্বমেধ’, ‘পিতৃমেধ’, ‘পুরুষমেধ’, ইত্যদি যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার স্বরূপ যে কী হত ভাবলেই শিহরণ জাগে!


মেধমানেই কিন্তু নিছক মাথা কেটে নেওয়ানয়। ঘটনাচক্রে, ‘উৎসর্গ করামানেও শুধু বলি দেওয়ানয়। মেধ্’-এর একটি অর্থ সঙ্গম। (প্রজায়ৈ গৃহমেধিনাম রঘুবংশ) সঙ্গম ভাবগত ভাবে একটি সৃষ্টিশীল ক্রিয়া। তাই মানুষের যে গুণ সর্বসাধারণের জন্য হিতকর বা তার সৃষ্টিশীলতার মেধ্এর আধার(আ)-কে মেধাবলা হয়। মেধমেধাদুটি শব্দই '√মেধ্ ধাতু থেকে সৃষ্টি হয়েছে (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ’ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। মেধ্ ধাতুর অর্থ মনে রাখা’ (সূত্র: ধাতু পারায়ণ’ – বন্দ্যোপাধ্যায়ি শ্রীযুক্ত লালকমল বিদ্যাভূষণ)।

সূর্য্যোদয়ের কথা


ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের (মধুবিদ্যা) ষষ্ঠ থেকে একাদশ খন্ডের বর্ণনা অনুসারে যুগ অনুসারে সূর্য্যের উদয় ও অস্তের দিক পরিবর্তন হয়! – (১) পৃথিবীতে বসুগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য পূর্বে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, (২) রুদ্রগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য দক্ষিণে উদিত হয়ে উত্তরে অস্ত যায়, (৩) আদিত্যগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য পশ্চিমে উদিত হয়ে পূর্বে অস্ত যায়, (৪) মরুদ্গণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য উত্তরে উদিত হয়ে দক্ষিণে অস্ত যায় ও (৫) সাধ্যগণের আধিপত্য থাকলে ঊর্দ্ধে উদিত হয়ে অধে অস্ত যায়! ... এখানে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ-কে ভৌগলিক দিক বুঝলে আর সূর্য্য শব্দের অর্থ ‘নক্ষত্রবিশেষ’ বুঝলে এই বক্তব্যগুলি অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর শোনায়। সূর্য্য শব্দটি এখানে ‘রাষ্ট্রীয় শক্তি বা সম্পদ’ অর্থে ও উদয়-অস্ত সেই সম্পদের ধারার অভিমুখ। আজকের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদের উৎস ও বরাদ্দকরণের খাত’। আপাতত, রুদ্রযুগ ও আদিত্যযুগে সূর্য্যের ‘গতিপথ’ ব্যাখ্যা করা হল।
• রুদ্রযুগ
o যুগনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: রুদ্র। রোদয়িতা, ভীষণ, শিবের সংহারক রূপ। (রুদ্র = √রুদ্ + র। √রুদ্ থাকেই ‘রোদন’। ) রোদন হল ক্রন্দন বা তাণ্ডবের (ক্রোধ প্রকাশের) মাধ্যমে অথবা উভয়ের যুগপৎ প্রকাশের মাধ্যমে যন্ত্রণাকে দমন করা। রুদ্রেরা হল আদিম সমাজের জ্ঞানবাদীরা। এদের (জ্ঞানের) ‘শিখা বহনকারী’ বা ‘শিব’-ও বলা হয়। এদেরকে উপেক্ষা করে জ্ঞানহীন, দক্ষতাকেন্দ্রিক কর্মযজ্ঞ (দক্ষযজ্ঞ) শুরু হয়। যজ্ঞকালে জ্ঞানবাদীদের অনুগামী জনগোষ্ঠীর/ কর্মীবাহিনীর (সতী) ‘মৃত্যু’ ঘটে (দৈহিক মৃত্যু নয়)। তারা একান্ন বা বাহান্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। রুদ্রেরা তখন এই জ্ঞানহীন কর্মযজ্ঞ বন্ধ করতে উদ্যত হলে শেষ অবধি রফা হয় যে তাদের অনুগামী জনগোষ্ঠী/ কর্মীবাহিনীকে পুনর্বহাল করা দেওয়া হবে। পৌরাণিক বর্ণনা অনুসারে, এই রফার পর শিবের শিরে ‘অর্ধচন্দ্রের উদয়’ হয়। যে ‘চন্দ্র’ কিনা ব্যাক্তিপুঁজির প্রতীক (‘কদমতলায় কে?’ -নিবন্ধে এই ‘চন্দ্র’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে)। পরবর্তিকালে ‘পর্বে পর্বে বিন্যস্ত’ (পর্ব্বত, সংস্থা) সত্তার অংশ (কন্যা) হিসেবে কর্মীবাহিনীকে এই জ্ঞানবাদীদের কাছে পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু, তখন আবার ‘মদনভস্ম’ ঘটে। - ‘কামনা’হীন ‘রতি’ অবশিষ্ট থাকে। ‘রত’ (নিযুক্ত হওয়া) থেকে ‘রতি’। আজকের ভাষায় বললে, যেহেতু কর্মের উৎপাদনে বা ‘কর্মফলে’ আর অধিকার থাকে না, তাই কর্মীবাহিনী তখন ‘অনিচ্ছা সত্বেও’ যান্ত্রিকভাবে কর্মে ‘রত’ হয়। এই নব্য ব্যবস্থার ওপর সীলমোহর পড়ার উল্লেখ পাওয়া যায় ভগবদ্গীতায়! (‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’)...
o যেদিক সূর্য্যোদয় ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: দক্ষিণ। যেদিকে অধিক মজুরী বা দক্ষিণা জোটে। দক্ষিণ দক্ষদের দিক/ দিশা। দক্ষেরা কর্মকুশল হলেও তাদের সৃজনশীলতা নেই। দক্ষেরা তাই ‘অজ-মুণ্ড’। অ-জ = নেই জনন (সৃজনিশক্তি) যার। যে প্রত্যন্ত জনপদে কোনও রকম সৃজনশীলতা পৌছায় না/ চর্চিত হয় না, তাকে ‘অজ-গাঁ’ বলে। আর সম পরিমাণ ‘অজত্ব’ যেখানে বিরাজ করে (হেগেলের ভাষায় যেখানে dialectical discourse থাকে না) তাকে ‘সমাজ’ বলে।
o যেদিক সূর্য্যাস্ত ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: উত্তর। শ্রেষ্ঠত্বের দিশা। জ্ঞানচর্চার দিশা, যেদিকে সকল প্রশ্নের জবাব বা উত্তর মেলে।
o বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উদয়-অস্তের তাৎপর্য: রুদ্রযুগ হল উপার্জনের পক্ষে লাভজনক ‘প্রয়োগমুখিতা’ (একই কাজের পুনরাবৃত্তি) দ্বারা সৃষ্ট সম্পদ ব্যবহার করে গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব দানকারী ‘আবিষ্কারমুখিতা’র (স্বাভাবিক বিশুদ্ধতা বা ‘শিবতা’-এর) পন্থা গ্রহণ। দক্ষতার চর্চা ছেড়ে জ্ঞানচর্চার প্রতি রাষ্ট্রের/ সমাজের মনোনিবেশ। আজকের ভাষায়, ব্যাবসার উপার্জন গবেষণায় বরাদ্দ করা।
• আদিত্যযুগ
o যুগনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: আদিত্য। অদিতির পুত্র। ঋগ্বেদে (১০.৭২.৪) বলা হয়েছে ‘অদিতি হতে দক্ষ জন্মিলেন, দক্ষ হতে আবার অদিতি জন্মিলেন’! অদিতিকে প্রচলিত অর্থে ভগবান বা দেবতা ধরলেও এই কথার সার বোঝা দায়। অদিতি হল ‘অ-দ্বৈধীকৃত (দিতি)’ বা যে জনগোষ্ঠী অখণ্ডবাদিতা যাপন/ বিশ্বাস করে। দীর্ঘদিন এইরূপ জীবনযাপনের ফলে যে ‘দক্ষতা’ জন্মায়, সেই দক্ষতা আবার সমাজের অখণ্ডতা রক্ষা করে। ঋগ্বেদে দিতির পুত্রদের পাশাপাশি এই আদিত্যদের বহুবার ‘অ-সুর’ (প্রচলিত নিয়মের বিরোধী) বা ইন্দ্রের (প্রভুত্বকারীদের) বিরোধী বলা হয়েছে।
o যেদিক সূর্য্যোদয় ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: পশ্চিম। যা পশ্চাতে বা পরে উদ্ভূত হয়েছে। এক্ষেত্রে অপামর জনসাধারণের মধ্য থেকে সমাজের ‘ওপরে উঠে আসা’ শ্রেণীর ভাবধারা/ দর্শন/ দিশা।
o যেদিক সূর্য্যাস্ত ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: পূর্ব। উৎস। এক্ষেত্রে অপামর জনসাধারণের ভাবধারা, আদি অখণ্ড জনগোষ্ঠীর ভাবধারা/ দর্শন/ দিশা।
o বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উদয়-অস্তের তাৎপর্য: ‘আদিত্য’ শব্দটিকে লক্ষ্য করলে আন্দাজ পাওয়া যায়, -এটি ‘আদি’ বা উৎসের প্রতি যত্নশীলতার যুগ। আজকের পরিভাষায় বললে, আদিত্যযুগ একপ্রকার ‘affirmative action’–এর যুগ। ধন, জ্ঞান, দক্ষতা, ইত্যাদির আধিক্যে একটি শ্রেণী এগিয়ে গেলে সেই এগিয়ে থাকা শ্রেণীর ধন, দক্ষতা, ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় সম্পদ প্রয়োগ করে ‘পিছিয়ে পড়া’ শ্রেণীর উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের অখণ্ডবাদিতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা।

নামকরণের যুদ্ধ নাকি দেবাসুরের সংগ্রাম?


চলুন, স্মরণ করা যাক, -পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের সমাধিতে খোদিত কথাগুলি, ‘একজন পারসীক, একজন পারসীকের পুত্র, একজন আর্য্য, আর্য্যবংশোদ্ভূত’। এই দারায়ুস তথা আদি পারসীকদের ধর্মের নাম ‘মাজদা য়াস্ন/ য়স্ন', -যে ধর্মের প্রচারক ছিলেন জরাথুষ্ট্র। জরাথুষ্ট্রের গোত্রের নাম ‘স্পিতামা’। আবার অথর্ববেদের ভার্গব সংহিতা অনুসারে অসুর-গুরু শুক্রাচার্যের গোত্র-ও স্পিতামা! ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূত্রে ‘প্রভুত্বকারী’ বা ‘ইন্দ্র’ নামক সত্তার সাথে ‘পার্শব’ নামক এক জনগোষ্ঠীর মতবিরোধ, যুদ্ধ, ইত্যাদির উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষদিকে এই পার্শবরা একসময় নিজের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়। - ঋগ্বেদ ও আভেস্তা অনুসারে পার্শবদের এই এক্সোডাসের মূল কারণ, তারা পশুবলির বিরোধী ছিল! (ইতিহাসের কী বিড়ম্বনা! এখন তাদের এই ছেড়ে যাওয়া দেশে ফ্রীজে মাংস রাখলে মানুষের প্রাণ যায়!) এই পার্শবগণই আদি পারসীক। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘আবেস্তা’ বা ‘আর্য্যদের স্থান’। আবেস্তা অনুযায়ী তাদের জন্মস্থানের নাম ‘হপ্তহিন্দু’ (সপ্তসিন্ধু বা উত্তর ভারত) । ইন্দ্রকে তারা শয়তান বলে (আবেস্তা, ১০/৯)। আবেস্তায় সমস্ত কর্মের দুটি চালিকা শক্তির নির্দেশ পাওয়া যায়, -‘আহুর মাজদা’ (শুভ শক্তি) ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ (অশুভ শক্তি)। আবেস্তা ও বেদ, দুটি পৃথক ভাষায় রচিত হলেও এই ভাষাদুটির উৎস এক। যে’কারণে এই দুটি ভাষার অজস্র শব্দে ধ্বনিগত বা ‘ফোনেটিক’ সাদৃশ্য দেখা যায়। আবেস্তার ‘আহুর’ ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ -ঋগ্বেদের ‘অসুর’ ও ‘অঙ্গিরা মুনি’। অঙ্গিরা মুনি নামক সত্তা ছিলেন দেবপূজারীদের গুরু, স্বভাবতই তার/ তাদের আদর্শ পার্শবদের কাছে ছিল অগ্রহণীয়।
সুতরাং, শুভ-অশুভের বিচারে আবেস্তা ও ঋগ্বেদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বৈপরীত্যের কারণ কী? –কথিত আছে, ইন্দ্র ও তার অনুগামীরা ছিলেন ‘সমাজভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির’ জন্য পশুবলি বা পশুমেধ-এর পক্ষে, পার্শব বা আদি পারসীকরা ছিলেন এই প্রথার বিপক্ষে। কিন্তু এই সামান্য কারণে এত বিশাল এক জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে পারে? – ‘অশ্ব’, ‘হস্তী’, ‘অজ’, ‘বৃষ’... ও ‘মেধ’ (স্মর্তব্য 'মেধা' শব্দ-টি) শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থগুলি বিবেচনা করলে বোঝা যায় এই বিরোধের মূল কারণ পশুহত্যা নয়, সমাজের সামগ্রিক রীতিনীতি।
পরশুপুরী (পেশোয়ার), মাদ্র (মিডিয়া), পৃথু (পার্থিয়া), কুরুশ্রাভন (খোরাসান), বল্হীক (বল্‌খ), পারস্য (ইরান) ইত্যদি স্থানে পার্শবেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু শুধু পার্শবগণ একমাত্র ‘অ-সুর’? -পুরাণ অনুসারে অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। তাদের নামেই তাদের দেশের নামকরণ হয়। অঙ্গ মানে পূর্ব বিহার, বঙ্গ মানে দক্ষিণ বাংলা, কলিঙ্গ মানে উড়িষ্যা, পুণ্ড্র মানে উত্তর বাংলা ও সুহ্ম হল দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা। ইন্দ্র-বিরোধীদের একদল চলে গিয়েছিল আর্য্যাবর্ত্তের পশ্চিমে আর আরেকদল গিয়েছিল পূর্বে। একদিকে জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের উত্থান হলে অন্যদিক তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

কংসের গল্প

কংসের গল্প ভাবা যাক, -লোকটি আগেই জেনে ফেলল ভাগ্নের হাতে তার মরণ। বোন-ভগ্নীপতিকে গ্রেফতার করল, অতগুলো বাচ্চা মারল, তবুও ‘ভাগ্নে’র জন্ম আটকাতে পারল না! -এই কাহিনী ‘সত্য’ হলে কংসের, আর ‘কল্পনা’ হলে ব্যাসদেবের বুদ্ধি নিয়ে যে কোনও যুক্তিবান মানুষের-ই সন্দেহ জাগবে। - বোন আর ভগ্নীপতিকে দু’টো আলাদা ঘরে বন্দী রাখলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত, কারাগারে কি প্রকোষ্ঠ কম পড়েছিল? আসল রহস্য কী? –logical error নাকি lost in translation? একজন দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা বা একজন মহান লেখক এমনধারা ভুল করবেন, -মানতে কষ্ট হয়।
শব্দার্থবিধি না চিনে প্রথমে যদি ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ –স্তবকের শুধু আক্ষরিক অর্থটুকুই ধরি, আর তারপর ‘সুগন্ধী হিসেবে রৌদ্রের উপকার’ –গোছের টিকা রচনার প্রয়াস করি, -তাহলে তা শুধু ত্রুটিপূর্ণ-ই নয়, হাস্যকর-ও। আসল সমস্যা হল, ‘কংস’ শব্দটি শুনলে একজন ‘ভোজবংশীয় রাজা’-ই মাথায় আসে। কাঁসার বা ‘কংস’ধাতুর থালায় খেয়েছি, তবু লক্ষ্য করি নি -এই ধাতুটি আসলে ‘একাধিক দুর্বল সত্ত্বার সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি সবল ও উজ্জ্বল সত্ত্বা’ (ব্যক্তি-বিশেষ নয়)। বৃহত্তর অর্থে একটি ‘শক্ত-সবল যৌথসমাজ’। -যার জন্মদাতা ‘উগ্র-সেন’। শব্দকল্পদ্রুম অভিধান অনুসারে ‘সেনা’ শব্দটি ‘সেন’ শব্দের প্রকৃতিরূপ! আবার ‘ক্ষেত্র-ক্ষেত-ক্ষত্র-ক্ষত্রিয়’ –এই শব্দপরিবারের দিকে তাকালে আন্দাজ করা যায় এই ‘সেন’ বা ‘সেনা’র পূর্বপরিচয়। এদিকে দূর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রীমদ্ভাগবত’ অনুসারে কংস উগ্রসেনের ‘ক্ষেত্রজ’ (ক্ষেত্র হইতে জাত) সন্তান! –পুরো ব্যাপারটা কি তাহলে আজকের ভাষার ‘কৃষক অভ্যুত্থান’? -হতেই পারে! পালবংশের আগেও হয়তো এদেশের জনগণের তাদের রাজা বা নেতা নির্বাচন করেছিল।
যাই হোক, এই কংসের বিনাশ ঘটিয়ে (তার-ই জমিতে) ‘পুঁজিবাদের অবতার’ (কার্ল মার্কসের কথায়, ‘…the world still jogs on, solely through the self-chastisement of this modern penitent of Vishnu, the capitalist.’ - Capital, Vol. - 1, Chapter - 24, Sec. - 3) ‘কৃষ্ণ’ধনের রাজত্ব শুরু। যৌথসমাজের সেই আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। কৃষ্ণধনের সম্ভাব্য উৎসগুলিকে সে সবরকম ভাবে অবরুদ্ধ বা ‘restrict and restrain’ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু, একসময়ে এসে তার রক্ষীরা তন্দ্রা যায়, ‘iron curtain’ লুটিয়ে পড়ে। কৃষ্ণধনের ‘গোপনে বাড়া’র কথা জেনেও যৌথসমাজ তাকে ‘খতম’ করতে ব্যর্থ হয়। জন্মমাত্রই তার রূপে গুণে মানুষ মুগ্ধ। সে জগতবাসীর ঘরের মাখন (মানসিক অর্জন, উপার্জিত ধন) চুরি করে ফাঁক করলেও মানুষ তাকে আশকারা-ই দেয়। মাঝেমাঝে অনুযোগ জানাতে গেলে পণ্যবাদ হরেকরকম ‘লীলা’ দেখাতে শুরু করে। তার বাঁশীর সুরে (বিজ্ঞাপনের চটকদারিতে) পুরনারীদের ‘মাখনে’র পর চরিত্রটুকুও যায়।... ওদিকে জগতবাসীর ট্যাঁক ফাঁকা করা ‘নৈবেদ্য’য় ফুলে-ফেঁপে ওঠে (বাণিজ্যের জমিতে) ‘ধন-বর্ধন’ পর্বত (ভোলা উচিৎ নয়, ভারতের আদি মুদ্রা ছিল গরু) । বিপদে পড়লে সেই পর্বতকেই আবার রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।...
এই বিষ্ণু বা নারায়ণ প্রথমে জ্ঞানবাদী বা ‘গদাধারী’ ছিল। {গদ = ‘গামীর দাতা যাহাতে’ বা ‘যে শব্দ কথকের মনোভাব বহন করে’। গদগদ = জ্ঞানের কথায় মজে যাওয়া। গদাঘাত = যুক্তির আঘাত। ‘গদ’-এর চলমান বা যোগ্য (য) রূপ হল ‘গদ্য’।} পরে সেই ‘গদ’-এর ন-করণের (negation) ফলে সে পুঁজিবাদী বা ‘ন-গদ নারায়ণ’ হয়ে যায়। সময়ের প্রয়োজন অনুসারে যার দশরকম manifestation. তার অনুগামী (স্ত্রী) ধনের দেবী, -যে আবার ‘বাণিজ্যে বাস করে’।...
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ভাবে ভাষাতত্ত্বের রাস্তায় ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? ইতিহাসকার নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১) বা জার্মান নৃতত্ববিদ ইগন ফ্রিয়েরার ভন ইক্সস্টেড (Egon Freiherr von Eickstedt, 1892- 1965) -দের মতে ভাষাতত্ত্ব বাদ দিয়ে শুধু নৃতত্ত্বের মাধ্যমে ঐতিহাসিক জনতত্ত্ব (demographics)-এর সঠিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। ‘দ্যা জার্নাল অফ্ আফ্রিকান হিস্ট্রি’ অনুসারেও আফ্রিকা মহাদেশে প্রাচীন ইতিহাস সন্ধানে অন্যতম প্রধান পন্থা ছিল ভাষাতত্ত্ব।

‘জঘন্য’

একটি খাজা সিনেমা দেখার পর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল একটি শব্দ, -‘জঘন্য’। তারপর, বেজায় সমস্যায় পড়া গেল সেটিকে নিয়ে। এই তৎসম শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘জঘনভব’ বা ‘জঘনতুল্য’ {জঘন + য (যৎ)}। কিন্তু, এই অর্থ শেষ অবধি ‘নিকৃষ্ট’/ ‘নিন্দনীয়’ বা ‘কুৎসিত’-এ দাঁড়াল কেন, -সে এক রহস্য! ‘জঘন’ শব্দটি বেদে ব্যবহৃত। -‘আ জঙ্ঘন্তি সান্বেষাং জঘনাঁ উপজিঘ্নতে। অশ্বাজনি প্রচেতসোহশ্বান্ সমৎসু চোদয়॥’ (ঋগ্বেদ ৬.৭৫.১৩) –এর অর্থ হল বুদ্ধিমান অশ্বের (প্রচেতসঃ অশ্বান্) জঘন প্রদেশে পুনঃ পুনঃ আঘাত করে (উপজিঘ্নতে) তাকে যুদ্ধে (সমৎসু) নিযুক্ত/ প্রেরণ (চোদয়) কর।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য যে ‘নিযুক্ত করা’ বা ‘প্রেরণ করা’ অর্থে ব্যবহৃত ‘চোদয়’ শব্দটি এসেছে ‘√চুদ’ ধাতু থেকে। শব্দটি বর্তমান রূপ আধুনিক বাংলাভাষায় ইতর শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বিচার করলে বোঝা যায় সেখানেও মূল/ আদি অর্থ আসলে অপরিবর্তিতই রয়েছে। ঘটনাচক্রে, সভ্যজনের দ্বারা আপাতনিন্দিত শব্দটি কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্রেও উপস্থিত, -‘...ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ॥’ (ঋগ্বেদ, ৩.৬২.১০)।...
যাই হোক, বোঝা গেল যে বৈদিক (ছান্দস) ভাষায় ‘জঘন’ শব্দটির একটি অর্থ ‘কটিদেশ’। এরপর পঞ্চতন্ত্রে পাওয়া গেল ‘...পরমসুখং জঘনচপলায়াঃ’, অর্থাৎ কিনা ‘জঘন’ হল (নারীদেহের) নিতম্ব-পরিসর। (ইঙ্গিত বুঝে বাৎসায়ন, দামোদর গুপ্ত, জয়দেব, প্রমুখের রচনা আপাতত বাদ দেওয়া হল, কারণ সেখানে অন্য কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।) এরপর ধর্মমঙ্গল কাব্যেও শব্দটির অর্থের তেমন কিছু পরিবর্তন হয় নি (‘জঘনে জঘনে যুগ্ম বদনে বদন। নাগর নাগরী কোলে নিদ্রায় মগন॥’)। তাহলে যে জঘন ‘পরমসুখং’ বা ‘চপলায়াঃ’, তার ‘-তুল্যতা’ নিন্দনীয় হবে কেন?
উত্তর মিলল মনুসংহিতায়। এই আইনগ্রন্থটিতে নারীর স্থান কহতব্য নয়। ইহলোকে পুরুষকে দূষিত করা নাকি নারীদের স্বভাব (‘স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম্‌’)!... রূপ বা বয়সের কোনও বাছবিচার না করে পুরুষ পেলেই নারী তাকে ভোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে (‘নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্হিতিঃ। সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে’)!... এমনকি, নিজের মা বোন বা মেয়ের সাথেও নাকি সেই কারণে একা থাকতে নেই (‘মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ’)!... আর না এগোনোই ভাল। যাই হোক, যে শাস্ত্রকারগণ নারী সম্বন্ধে এমন ‘উচ্চ’ ধারণা পোষণ করতেন, নারীর অঙ্গবিশেষের প্রতি তাদের (অন্ততঃ লোকদেখানো) দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হবে –তা বলাই বাহুল্য! কিন্তু, তারা এখানেই থেমে থাকলেন না। বললেন, ‘উত্তমমাং সেবামানস্তু জঘন্যো বধমর্হতি।’ (৮.৩৬৬) অর্থাৎ, উচ্চবর্ণের কন্যাগমনকরী শুদ্র বধ্য বা বধযোগ্য হবে। ‘জঘন্য’ শব্দের অর্থ এখানে ‘শুদ্র’। আর শুদ্র মানেই তো হীন নীচ, সুতরাং-। একটি মাত্র শব্দের মাধ্যমে প্রথমে নারীজাতি, তারপর ভূখণ্ডের পনেরো আনা মানুষকেই তারা নিকৃষ্ট, নিন্দনীয় বলে দাগিয়ে দিলেন! কে জানে এমন কত অন্যায়ের উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি আমাদের ভাষায়। ভাগ্যিস, সমস্ত শব্দের ব্যুৎপত্তি জানা নেই!...

লিপি

অধিকাংশ ভারতীয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্রাহ্মী লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন, প্রিপ্রাবা লিপিটি একটি কৌটার উপর খোদিত ছিল। কথিত আছে, সেই কৌটোটিতে নাকি বুদ্ধদেবের অস্থি ছিল। তার থেকে ধারণা করা হয় এ লিপিটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৫০০ সময়কালের। মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভ লিপিতে ব্রাহ্মীর অনেক পরিণত ও পূর্ণাঙ্গরূপ দেখা যায়। যা থেকে ধারণা করা হয় বহুদিন ধরে দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি অশোক লিপির পর্যায়ে পরিণত হয়।
কুষাণ ও গুপ্ত যুগে প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপি পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং শেষ অবধি মোটামুটি তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মীর এই তিনটি ধারা থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্রাহ্মীর যে রূপটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘সারদা' লিপি। উত্তর ও মধ্য ভারতে যে ধারাটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘নাগরলিপি'/ ‘নাগরীলিপি’। পূর্ব ভারতে যে ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার নাম ‘কুটিল লিপি'। পণ্ডিতদের মতে, এই ‘কুটিল লিপি' থেকে আধুনিক বাংলা লিপির উদ্ভব। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত সমাচার দেবের (আনুমানিক ৫২৫-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তাম্র শাসনটি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন। পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপালের (দশম শতাব্দী) বাণগড় লিপিতে দেখা যায় যে এগারোটি বর্ণ আধুনিক বাংলা বর্ণের রূপ নিয়েছে।
অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝে বাংলার লিপিতে নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে এবং পূর্বভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে, যাকে ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি বলা হয়। (‘প্রোটো-’ শব্দের অর্থ ‘প্রায়-’) এই লিপি পরিবর্তনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের উদ্ভব। বাংলায় ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি খুব বেশি দিন চালু ছিল না। স্থানীয় লিপিকরদের কুটিল লিপির প্রভাবে এই ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রোটো-নাগরী ও কুটিল লিপির সম্মিলিত প্রভাবে বাংলা অঞ্চলের লিপি নতুন রূপ পায়, যাকে ‘প্রোটো-বাংলা’ বলা হয়। ঘটনাচক্রে, পালযুগের ‘অষ্টসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতা’ এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম্’ –এর পাণ্ডুলিপিগুলি প্রোটো-বাংলা লিপিতে রচিত।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেন, যাকে সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় কারণ, পিতা হেমন্ত সেনের প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র সেন রাজ্যকে তিনিই পরাক্রমশালী সম্রাজ্যে পরিনত করেন। এই বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ বিজয়ের পর বর্তমান রাজশাহী জেলার দেওপাড়ায় যে ‘বঙ্গাল প্রশস্তি’ স্থাপন করেন, তার প্রায় বাইশ-তেইশটি বর্ণের রূপ আধুনিক বাংলা লিপির মতো।
ত্রেয়োদশ শতাব্দীতে ‘বজ্রায়নেসাধনাঙ্গানি’, ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘গূহ্যাবলীবিবৃতি’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে আধুনিক বাংলা লিপির নিদর্শন পাওয়া গেলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত বড়ুচন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে বাংলা লিপি আরও পরিণত হয়। তবে উনবিংশ শতাব্দীতে ছাপাখানা চালু হওয়া ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার হওয়া অবধি স্থান-কাল বিশেষে বাংলালিপির কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটেই চলেছিল। আবার অনেকের মতে বাংলা লিপির উদ্ভব নাকি নাগরী লিপির সহোদর ‘সিদ্ধং/ সিদ্ধাম লিপি’ থেকে। সিদ্ধং শব্দের অর্থ "সম্পন্ন’ অথবা "নিখুঁত’। একদল পণ্ডিৎ সিদ্ধং (পরবর্তীকালে ‘সিদ্ধিমাতৃকা’) লিপিকে বাংলা ও অসমিয়ার পাশাপাশি ‘কানা লিপি’ (জাপানি ভাষা) ও তিব্বতি লিপির জননী মনে করেন। অনেকে আধুনিক বাংলা ও অসমিয়া লিপিকেও ‘সিদ্ধিমাতৃকা’ বা ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপি বলেন।
এদিকে চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশের সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জ অঞ্চলে আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির মিশ্রণে ‘সিলেটি নাগরী’ লিপির উদ্ভব ঘটে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ধর্মীয় পরিব্রাজক শাহ জালাল এই লিপি সিলেট অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন। শাহ জালাল ছিলেন সুফি সাধক আর সিলেটি নাগরী লিপিতে রচিত অধিকাংশ সাহিত্যকর্মে সুফিবাদের উপস্থিতি এই মতকে সমর্থন করে। অন্যদিকে ড. আহমদ হাসান দানীর মতো পণ্ডিৎবর্গের মতে, আফগান শাসনের সময় এই লিপির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ঘটনাচক্রে, সমসাময়িক আফগান মুদ্রায় উল্লেখিত লিপির সাথে সিলেটি নাগরীর কিছু বর্ণের সাদৃশ্য ছিল। এই লিপির অন্য নামগুলি হল জালালাবাদী নাগরী, ফুল নাগরী, মুসলমানী নাগরী, মোহাম্মদী নাগরী, ইত্যাদি। বর্তমানে এর কোনও ব্যবহার নেই বললেই চলে।
(কৃতজ্ঞতা: ‘The Origin of the Bengali Script’ – Rakhaldas Bandyopadhyay, ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ - Suniti Kumar Chatterji, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ –দীনেশচন্দ্র সেন, ‘বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর’ – অতুল সুর, ‘বাংলা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস’ - এস. এম. লুৎফর রহমান, ‘বর্ণমালার উদ্ভব বিকাশ ও লিপিসভ্যতার ইতিবৃত্ত’ - দেওয়ান গোলাম মোস্তফা, ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: শব্দের বিবর্তন বৈচিত্র্য’ - মনজুর রহমান, ‘বাংলা লিপির উৎপত্তি’ - সাইফুদ্দীন চৌধুরী, ইত্যাদি।)

ভদ্রতা

‘ভদ্র’ শব্দের বর্তমানে প্রচলিত অর্থগুলি হল অমায়িক, নম্র, সুপ্রতিষ্ঠিত, ইত্যাদি। কিন্তু মনুসংহিতা অনুযায়ী ‘যে গোপনে পাপ করে ও প্রকাশ্যে তা প্রচ্ছন্ন রেখে পর-ধন গ্রহণ করে, সে হল ভদ্র।’ –কি মারাত্মক কথা! এই সংজ্ঞায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আধুনিক ‘ভদ্রলোক’দের আসল চরিত্র ফুটে উঠলেও ‘ভদ্র’ শব্দটির প্রতি এ যে ঘোর অন্যায়! এখন এই ‘গোপন পাপে’র রহস্য নিষ্পত্তি করতে তন্ত্রশাস্ত্রে পৌছে দেখা গেল সেখানে ‘ভদ্র’ শব্দের অর্থ –‘চৌষট্টি কলায় পারদর্শী দক্ষ বা ভৃগুগণ’। -এ’ কি বাৎসায়নের কামসূত্রে বর্ণিত ৬৪ কলা? (শাস্ত্রকাররা কি ভদ্রলোকদের বিড়ম্বনার শেষ রাখেন নি!) দেখা যাক, এই কলাসমূহে কী পাওয়া যায়;-
কণ্ঠসংঙ্গীত, যন্ত্রসংঙ্গীত, নৃত্যকলা, অঙ্কন বিদ্যা, সীমন্ত/ কেশসজ্জা রীতি, কালভেদে রুচিভেদে ঋতুভেদে ও অবস্থাভেদে শয্যা প্রস্ত্তত প্রণালী, গৃহসজ্জা রীতি, অঙ্গরাগ (make-up) বিদ্যা, গৃহ নির্মাণ, রঙ্গরচনা, সন্তরণ ও জলক্রীড়া, চিত্রযোগে অপরের দৌর্ভাগ্যীকরণ বিদ্যা, পুষ্পালংকার প্রস্তুতি, সুগন্ধি প্রস্তুতি, বেশভুষা উদ্ভাবন, পরিচ্ছদ রচনা (tailoring), স্বর্ণকার বিদ্যা, আতিথিয়তা, জাদুবিদ্যা, হস্তলাঘব কর্মকুশলতা, রন্ধন, পানীয় ও মিষ্টান্নাদি প্রস্তুতি, তন্তুবায় বিদ্যা, সূচিশিল্প, বীণা-ডমরুক-বাদ্য তন্ত্রবিদ্যা, প্রহেলিকা রচনা, কাব্য রচনা, ভাষাতত্ত্ব, শ্লোক পাঠ, নাটক-অভিনয়-দর্শনের সমালোচনা, কাব্যের লুপ্ত পংক্তির পুনরুদ্ধার ও অনুলেখন, পট্টিকাবেত্রবয়ন (তৃণ/ বেত থেকে আসবাব রচনা), কুঁদনবিদ্যা (wood carving), তক্ষণ (carpentry), মণিভূমিকাকর্ম (jewel cutting/ polishing), রসায়ন ও ধাতু বিদ্যা, মৃৎশিল্প, উদ্যানপালন, পশুপালন, পক্ষীপালন, গাত্রমর্দন বিদ্যা, সংবাদ জ্ঞাপন ও প্রাপ্তি, সংকেতলিপি রচনা ও অর্থোদ্ধার (cryptography), অনুবাদ বিদ্যা, বাহন নির্মাণ ও পরিচর্যা, প্রতীকবিদ্যা, নানাবিধ যন্ত্রবিদ্যা, স্মৃতিশাস্ত্র বিদ্যা, পুস্তক পাঠ, পুস্তক রচনা, অভিধান ও বিশ্বকোষ বিদ্যা, ছন্দজ্ঞান ও বক্তৃতা বিদ্যা, ছদ্মবেশ বিদ্যা, দাবা ও পাশা খেলা, কুহক বা মোহিনী বিদ্যা, স্থলক্রীড়া বিদ্যা, ব্যায়ামবিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, মুখাকৃতির বিচারে চরিত্রনির্ণয়বিদ্যা (physiognomy), বার্ণিক (নকলনবিসি) বিদ্যা, মৃত্তিকা-ভাষ্কর্য এবং গণিত।...
দেখা যাচ্ছে, ‘যৌনশাস্ত্র’ হিসেবে পরিচিত হলেও কামসূত্রের এই চৌষট্টি কলায় ‘কামোত্তেজক’ (aphrodisiac অর্থে) বিশেষ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এ’গুলি বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখা বা ‘faculty’। অখণ্ড-জ্ঞান (ভারতীয় দর্শনে যার উৎসকে ‘পরম ব্রহ্ম’ বলা হয়) সীমাহীন। কোনও বাস্তব মানুষের সীমিত ক্ষমতার দ্বারা সেই অখণ্ড জ্ঞানের অসীমতার সম্পূর্ণ নাগাল পাওয়া অসম্ভব। জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাই অখণ্ড জ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলনের জন্য সাধ্যমত তাকে ৬৪ খণ্ড/ কলা/ বিদ্যা/ ধারায় (৬৪টি ‘specialised faculty’-তে) ভাগ করেছিল। বর্তমানে যা আরও specialised হতে হতে ৬৪০ বা ৬৪০০টি উপধারায় পরিণত হয়েছে।