সতীর কথা


সতী = ‘সত’-এর ভাব সক্রিয় (ই) যাহাতে। - যে জনগণ সামাজিক/ প্রাতিষ্ঠানিক আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলে (বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ)। আইন-শৃঙ্খলার ‘মৃত্যু’ হলেই ‘সতী’দের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, তারা ভেতরে ভেতরে ‘জ্বলে-পুড়ে মরে’। -এই হল ‘সতীদাহ’। বাইরে থেকে গায়ে আগুন দিতে হয় না!

আসলে, পণ্যের উৎপাদন শুরু হওয়ার বহু আগেই এই ভূখণ্ডের মানুষ ‘পরিচালক ও পরিচালিত’ (‘শিব ও সতী’) –এই দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে পরেছিল। (‘In the primitive Indian community there is social division of labour, without production of commodities.’ - Section 2, Capital, Volume 1. –Karl Marx) ফলে, পরিচালকের অনুপস্থিতিতে পরিচালিতের অস্তিত্ব বিঘ্নিত হত। বিষয়টি সহজ করে বোঝার জন্য উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, রামবাবু ‘ক’ প্রতিষ্ঠানে কেরানির পদে কর্মরত। সুতরাং ক-নামক প্রতিষ্ঠানটি এখানে পরিচালক বা শিব আর রামবাবুর ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটি হল পরিচালিত বা সতী। এখন ক-নামক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হলে (মৃত্যু ঘটলে) একই সাথে রামবাবুর ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটির মৃত্যু ঘটে। ব্যাক্তি রামবাবু তারপর ‘খ’ প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতেই পারেন, কিন্তু তাহলেও তার ‘ক-নামক প্রতিষ্ঠানের কেরানি’ সত্ত্বাটি পুনর্জীবিত হয় না। (আর যেহেতু সচ্চরিত্রের মহিলার মধ্যেও ‘সৎ-এর ভাব সক্রিয়’, তাই সে-ও সতী।)

এবার রইল বাকি ‘সহমরণ’ অর্থে সতীদাহের প্রসঙ্গ; -এর প্রথম ও প্রধান কারণ ছিল বিধবার সম্পত্তি হরণ ও তার দায়-দায়িত্ব বর্জন। এছাড়াও (রামমোহন রায়ের ভাষায়) ‘...লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সহমরণ করিলে এ আশঙ্কা থাকে না...’। ঋগ্বেদের যে শ্লোকটিকে (১০.১৮.৭) এককালের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ সহমরণের সপক্ষে ব্যবহার করত, সেটি হল, ‘ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাঞ্জনেন সর্পিষা সং বিশন্তু। অনশ্রবোহনমীবাঃ সুরত্না আরোহন্তু জনয়ঃ যোনিমগ্রে॥’ আসলে যার অর্থ হল, ‘এ সকল নারী বৈধব্য দুঃখ অনুভব না করে, মনোমত পতিলাভ করে অঞ্জন ও ঘৃতের সাথে গৃহে প্রবেশ করুন। এ সকল বধূ অশ্রুপাত না করে, রোগে কাতর না হয়ে উত্তম উত্তম রত্নধারণ করে সর্বাগ্রে গৃহে আসুন।’ (অনুবাদ: রমেশচন্দ্র দত্ত) কিন্তু, এই শ্লোকটির ‘আরোহন্তু জনয়ঃ যোনিমগ্রে’ –অংশের ‘যোনিমগ্রে’ (বা যোনিং অগ্রে) শব্দটিকে ‘যোনিমগ্নেঃ’ (বা যোনিং অগ্নেঃ) হিসেবে পাঠ করে (বিকৃত করে) সহমরণের পৃষ্ঠপোষকেরা প্রথাটিকে ‘বেদসম্মত’ ঘোষণা করেছিল!

ঘটনাচক্রে, ঋগ্বেদে এর পরের শ্লোকটিই (১০.১৮.৮) হল, ‘উদীর্ষ্ব নার্ষভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।...’ যার অর্থ, নারী তুমি সংসারে ফিরে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ সে মৃত।... পরের লাইনে ‘সংসারে ফিরে চলতে’ বলা হলে তার আগের লাইনে কোনও যুক্ততেই ‘আগুনে পুড়ে মরার’ আদেশ থাকতে পারে না। এমনকি অথর্ববেদেও (১৮.৩.১.১) ‘জীবলোকের উদ্দেশ্যে মৃত পতির পাশ থেকে উঠে আসতে’ বলা হয়েছে (উদীষর্ব নার্যভি জীবলোকং গত্যসুমেতমুপ শেষ এহি)। একশ্রেণীর লোকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য শতকের পর শতক একটি কুপ্রথার লাগাতার গুণগান ও মগজধোলাই চালিয়ে যাওয়ার ফলে বলপ্রয়োগে সতীদাহের পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের স্বেচ্ছায় সহমরণের উদাহরণও অবশ্য পাওয়া যায়। (ঠিক যেমন তথাকথিত ধর্মের বা আদর্শের জিগির তুলে পর্যাপ্ত মগজধোলাই করার ফলে আজও কিছু মানুষ আত্মঘাতী সেনাদলে নাম লেখায়।)

অবশ্য মনুসংহিতা, ব্যাসসংহিতা, অত্রিসংহিতা, ইত্যাদি আইনগ্রন্থে সহমরণের প্রথাকে বেশ ভাল রকম গৌরবান্বিত করা হয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার ‘হিন্দু প্রতিক্রিয়া যুগে’, অর্থাৎ মৌর্য্যযুগের পতনের পর জন্মগত ব্রাহ্মণত্ব ও পুরুষতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এই আইনগ্রন্থগুলির ব্যাপক ‘সংশোধন’ করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা ‘স্বয়ম্ভূ মনু’ কতৃক রচিত বলে ওই দাবী করা হলেও তার যে সংস্করণটি প্রচলিত, সেটিকে রচনা করেছিল সুমতি ভার্গব নামের এক ব্রাহ্মণ, ১৭০-১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, পুষ্যমিত্র শুঙ্গের আমলে। (সূত্র: ‘নারদস্মৃতি’, সম্পাদনা ও অনুবাদ নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ।) আসলে পুষ্যমিত্র মৌর্য্য (বৌদ্ধ) সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যশাসন প্রতিষ্ঠা করার পর বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে এবং পুরোনো ধর্মশাস্ত্রকে বাতিল করে দিয়ে বর্ণব্যবস্থাকে জন্মগত বানিয়ে ব্রাহ্মণকে সবার ওপরের আসনে বসাতে এই গ্রন্থ রাজ অনুগ্রহে রচিত হয়। যার কয়েক পাতা ওল্টালেই বোঝা যায়, নারীর চরিত্র বিষয়ে সে সময়ের সমাজকর্তাদের আশঙ্কার শেষ ছিল না! কিন্তু, এমন নির্লজ্জ একচোখামির দরকার পড়ল কেন???

No comments:

Post a Comment