সূর্য্যোদয়ের কথা


ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের (মধুবিদ্যা) ষষ্ঠ থেকে একাদশ খন্ডের বর্ণনা অনুসারে যুগ অনুসারে সূর্য্যের উদয় ও অস্তের দিক পরিবর্তন হয়! – (১) পৃথিবীতে বসুগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য পূর্বে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, (২) রুদ্রগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য দক্ষিণে উদিত হয়ে উত্তরে অস্ত যায়, (৩) আদিত্যগণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য পশ্চিমে উদিত হয়ে পূর্বে অস্ত যায়, (৪) মরুদ্গণের আধিপত্য থাকলে সূর্য্য উত্তরে উদিত হয়ে দক্ষিণে অস্ত যায় ও (৫) সাধ্যগণের আধিপত্য থাকলে ঊর্দ্ধে উদিত হয়ে অধে অস্ত যায়! ... এখানে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ-কে ভৌগলিক দিক বুঝলে আর সূর্য্য শব্দের অর্থ ‘নক্ষত্রবিশেষ’ বুঝলে এই বক্তব্যগুলি অযৌক্তিক ও বিভ্রান্তিকর শোনায়। সূর্য্য শব্দটি এখানে ‘রাষ্ট্রীয় শক্তি বা সম্পদ’ অর্থে ও উদয়-অস্ত সেই সম্পদের ধারার অভিমুখ। আজকের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদের উৎস ও বরাদ্দকরণের খাত’। আপাতত, রুদ্রযুগ ও আদিত্যযুগে সূর্য্যের ‘গতিপথ’ ব্যাখ্যা করা হল।
• রুদ্রযুগ
o যুগনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: রুদ্র। রোদয়িতা, ভীষণ, শিবের সংহারক রূপ। (রুদ্র = √রুদ্ + র। √রুদ্ থাকেই ‘রোদন’। ) রোদন হল ক্রন্দন বা তাণ্ডবের (ক্রোধ প্রকাশের) মাধ্যমে অথবা উভয়ের যুগপৎ প্রকাশের মাধ্যমে যন্ত্রণাকে দমন করা। রুদ্রেরা হল আদিম সমাজের জ্ঞানবাদীরা। এদের (জ্ঞানের) ‘শিখা বহনকারী’ বা ‘শিব’-ও বলা হয়। এদেরকে উপেক্ষা করে জ্ঞানহীন, দক্ষতাকেন্দ্রিক কর্মযজ্ঞ (দক্ষযজ্ঞ) শুরু হয়। যজ্ঞকালে জ্ঞানবাদীদের অনুগামী জনগোষ্ঠীর/ কর্মীবাহিনীর (সতী) ‘মৃত্যু’ ঘটে (দৈহিক মৃত্যু নয়)। তারা একান্ন বা বাহান্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। রুদ্রেরা তখন এই জ্ঞানহীন কর্মযজ্ঞ বন্ধ করতে উদ্যত হলে শেষ অবধি রফা হয় যে তাদের অনুগামী জনগোষ্ঠী/ কর্মীবাহিনীকে পুনর্বহাল করা দেওয়া হবে। পৌরাণিক বর্ণনা অনুসারে, এই রফার পর শিবের শিরে ‘অর্ধচন্দ্রের উদয়’ হয়। যে ‘চন্দ্র’ কিনা ব্যাক্তিপুঁজির প্রতীক (‘কদমতলায় কে?’ -নিবন্ধে এই ‘চন্দ্র’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে)। পরবর্তিকালে ‘পর্বে পর্বে বিন্যস্ত’ (পর্ব্বত, সংস্থা) সত্তার অংশ (কন্যা) হিসেবে কর্মীবাহিনীকে এই জ্ঞানবাদীদের কাছে পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু, তখন আবার ‘মদনভস্ম’ ঘটে। - ‘কামনা’হীন ‘রতি’ অবশিষ্ট থাকে। ‘রত’ (নিযুক্ত হওয়া) থেকে ‘রতি’। আজকের ভাষায় বললে, যেহেতু কর্মের উৎপাদনে বা ‘কর্মফলে’ আর অধিকার থাকে না, তাই কর্মীবাহিনী তখন ‘অনিচ্ছা সত্বেও’ যান্ত্রিকভাবে কর্মে ‘রত’ হয়। এই নব্য ব্যবস্থার ওপর সীলমোহর পড়ার উল্লেখ পাওয়া যায় ভগবদ্গীতায়! (‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’)...
o যেদিক সূর্য্যোদয় ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: দক্ষিণ। যেদিকে অধিক মজুরী বা দক্ষিণা জোটে। দক্ষিণ দক্ষদের দিক/ দিশা। দক্ষেরা কর্মকুশল হলেও তাদের সৃজনশীলতা নেই। দক্ষেরা তাই ‘অজ-মুণ্ড’। অ-জ = নেই জনন (সৃজনিশক্তি) যার। যে প্রত্যন্ত জনপদে কোনও রকম সৃজনশীলতা পৌছায় না/ চর্চিত হয় না, তাকে ‘অজ-গাঁ’ বলে। আর সম পরিমাণ ‘অজত্ব’ যেখানে বিরাজ করে (হেগেলের ভাষায় যেখানে dialectical discourse থাকে না) তাকে ‘সমাজ’ বলে।
o যেদিক সূর্য্যাস্ত ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: উত্তর। শ্রেষ্ঠত্বের দিশা। জ্ঞানচর্চার দিশা, যেদিকে সকল প্রশ্নের জবাব বা উত্তর মেলে।
o বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উদয়-অস্তের তাৎপর্য: রুদ্রযুগ হল উপার্জনের পক্ষে লাভজনক ‘প্রয়োগমুখিতা’ (একই কাজের পুনরাবৃত্তি) দ্বারা সৃষ্ট সম্পদ ব্যবহার করে গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব দানকারী ‘আবিষ্কারমুখিতা’র (স্বাভাবিক বিশুদ্ধতা বা ‘শিবতা’-এর) পন্থা গ্রহণ। দক্ষতার চর্চা ছেড়ে জ্ঞানচর্চার প্রতি রাষ্ট্রের/ সমাজের মনোনিবেশ। আজকের ভাষায়, ব্যাবসার উপার্জন গবেষণায় বরাদ্দ করা।
• আদিত্যযুগ
o যুগনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: আদিত্য। অদিতির পুত্র। ঋগ্বেদে (১০.৭২.৪) বলা হয়েছে ‘অদিতি হতে দক্ষ জন্মিলেন, দক্ষ হতে আবার অদিতি জন্মিলেন’! অদিতিকে প্রচলিত অর্থে ভগবান বা দেবতা ধরলেও এই কথার সার বোঝা দায়। অদিতি হল ‘অ-দ্বৈধীকৃত (দিতি)’ বা যে জনগোষ্ঠী অখণ্ডবাদিতা যাপন/ বিশ্বাস করে। দীর্ঘদিন এইরূপ জীবনযাপনের ফলে যে ‘দক্ষতা’ জন্মায়, সেই দক্ষতা আবার সমাজের অখণ্ডতা রক্ষা করে। ঋগ্বেদে দিতির পুত্রদের পাশাপাশি এই আদিত্যদের বহুবার ‘অ-সুর’ (প্রচলিত নিয়মের বিরোধী) বা ইন্দ্রের (প্রভুত্বকারীদের) বিরোধী বলা হয়েছে।
o যেদিক সূর্য্যোদয় ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: পশ্চিম। যা পশ্চাতে বা পরে উদ্ভূত হয়েছে। এক্ষেত্রে অপামর জনসাধারণের মধ্য থেকে সমাজের ‘ওপরে উঠে আসা’ শ্রেণীর ভাবধারা/ দর্শন/ দিশা।
o যেদিক সূর্য্যাস্ত ও সেই দিকনামের অর্থ/ ব্যাখ্যা: পূর্ব। উৎস। এক্ষেত্রে অপামর জনসাধারণের ভাবধারা, আদি অখণ্ড জনগোষ্ঠীর ভাবধারা/ দর্শন/ দিশা।
o বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উদয়-অস্তের তাৎপর্য: ‘আদিত্য’ শব্দটিকে লক্ষ্য করলে আন্দাজ পাওয়া যায়, -এটি ‘আদি’ বা উৎসের প্রতি যত্নশীলতার যুগ। আজকের পরিভাষায় বললে, আদিত্যযুগ একপ্রকার ‘affirmative action’–এর যুগ। ধন, জ্ঞান, দক্ষতা, ইত্যাদির আধিক্যে একটি শ্রেণী এগিয়ে গেলে সেই এগিয়ে থাকা শ্রেণীর ধন, দক্ষতা, ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় সম্পদ প্রয়োগ করে ‘পিছিয়ে পড়া’ শ্রেণীর উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের অখণ্ডবাদিতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা।

No comments:

Post a Comment