নামকরণের যুদ্ধ নাকি দেবাসুরের সংগ্রাম?


চলুন, স্মরণ করা যাক, -পারস্যের সম্রাট দারায়ুসের সমাধিতে খোদিত কথাগুলি, ‘একজন পারসীক, একজন পারসীকের পুত্র, একজন আর্য্য, আর্য্যবংশোদ্ভূত’। এই দারায়ুস তথা আদি পারসীকদের ধর্মের নাম ‘মাজদা য়াস্ন/ য়স্ন', -যে ধর্মের প্রচারক ছিলেন জরাথুষ্ট্র। জরাথুষ্ট্রের গোত্রের নাম ‘স্পিতামা’। আবার অথর্ববেদের ভার্গব সংহিতা অনুসারে অসুর-গুরু শুক্রাচার্যের গোত্র-ও স্পিতামা! ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূত্রে ‘প্রভুত্বকারী’ বা ‘ইন্দ্র’ নামক সত্তার সাথে ‘পার্শব’ নামক এক জনগোষ্ঠীর মতবিরোধ, যুদ্ধ, ইত্যাদির উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষদিকে এই পার্শবরা একসময় নিজের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়। - ঋগ্বেদ ও আভেস্তা অনুসারে পার্শবদের এই এক্সোডাসের মূল কারণ, তারা পশুবলির বিরোধী ছিল! (ইতিহাসের কী বিড়ম্বনা! এখন তাদের এই ছেড়ে যাওয়া দেশে ফ্রীজে মাংস রাখলে মানুষের প্রাণ যায়!) এই পার্শবগণই আদি পারসীক। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ‘আবেস্তা’ বা ‘আর্য্যদের স্থান’। আবেস্তা অনুযায়ী তাদের জন্মস্থানের নাম ‘হপ্তহিন্দু’ (সপ্তসিন্ধু বা উত্তর ভারত) । ইন্দ্রকে তারা শয়তান বলে (আবেস্তা, ১০/৯)। আবেস্তায় সমস্ত কর্মের দুটি চালিকা শক্তির নির্দেশ পাওয়া যায়, -‘আহুর মাজদা’ (শুভ শক্তি) ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ (অশুভ শক্তি)। আবেস্তা ও বেদ, দুটি পৃথক ভাষায় রচিত হলেও এই ভাষাদুটির উৎস এক। যে’কারণে এই দুটি ভাষার অজস্র শব্দে ধ্বনিগত বা ‘ফোনেটিক’ সাদৃশ্য দেখা যায়। আবেস্তার ‘আহুর’ ও ‘অঙ্গর মইন্যু’ -ঋগ্বেদের ‘অসুর’ ও ‘অঙ্গিরা মুনি’। অঙ্গিরা মুনি নামক সত্তা ছিলেন দেবপূজারীদের গুরু, স্বভাবতই তার/ তাদের আদর্শ পার্শবদের কাছে ছিল অগ্রহণীয়।
সুতরাং, শুভ-অশুভের বিচারে আবেস্তা ও ঋগ্বেদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বৈপরীত্যের কারণ কী? –কথিত আছে, ইন্দ্র ও তার অনুগামীরা ছিলেন ‘সমাজভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির’ জন্য পশুবলি বা পশুমেধ-এর পক্ষে, পার্শব বা আদি পারসীকরা ছিলেন এই প্রথার বিপক্ষে। কিন্তু এই সামান্য কারণে এত বিশাল এক জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে পারে? – ‘অশ্ব’, ‘হস্তী’, ‘অজ’, ‘বৃষ’... ও ‘মেধ’ (স্মর্তব্য 'মেধা' শব্দ-টি) শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থগুলি বিবেচনা করলে বোঝা যায় এই বিরোধের মূল কারণ পশুহত্যা নয়, সমাজের সামগ্রিক রীতিনীতি।
পরশুপুরী (পেশোয়ার), মাদ্র (মিডিয়া), পৃথু (পার্থিয়া), কুরুশ্রাভন (খোরাসান), বল্হীক (বল্‌খ), পারস্য (ইরান) ইত্যদি স্থানে পার্শবেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু শুধু পার্শবগণ একমাত্র ‘অ-সুর’? -পুরাণ অনুসারে অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। তাদের নামেই তাদের দেশের নামকরণ হয়। অঙ্গ মানে পূর্ব বিহার, বঙ্গ মানে দক্ষিণ বাংলা, কলিঙ্গ মানে উড়িষ্যা, পুণ্ড্র মানে উত্তর বাংলা ও সুহ্ম হল দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা। ইন্দ্র-বিরোধীদের একদল চলে গিয়েছিল আর্য্যাবর্ত্তের পশ্চিমে আর আরেকদল গিয়েছিল পূর্বে। একদিকে জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের উত্থান হলে অন্যদিক তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

No comments:

Post a Comment