অশ্বমেধ ও ঘোড়ার মাথা

বৈদিক রচনায় ঘোড়াবা ঘোটকনেই, আছে অশ্ববেদের বুৎপত্তি গ্রন্থ নিরুক্ত। সেই নিরুক্ত বলে, -‘ব্যাপ্ত্যর্থক অশ্ ধাতুর উত্তর ক্কন্ প্রত্যয়ে অশ্ব শব্দের নিষ্পত্তি। অশ্ব নাম কোথা থেকে হল? অশ্ব পথ ব্যাপ্ত করে। অশ্ব মহাভোজন হয়। অশ্ব চলনপটু হয়। অশ্ব পথের কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। অশ্ব নিজের আকৃতির দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। অশ্ব চালকের প্রজ্ঞা বর্ধিত করে।’ –এখানে একবারের জন্যও ঘোটক বা কোনও ইতর জীবের ইঙ্গিত নেই, আছে কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সংকলন। বাংলায় অশ্বশব্দের আরেকটি অর্থ পাওয়া যায়, -‘চার জাতি পুরুষের চতুর্থজাতি’! –অশ্ব তাহলে পুরুষ! কিন্তু, এ কেমন পুরুষ’? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অথর্ব্ববেদে (১২.৪.৭) কিশোরশব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মানব-অশ্বগণের সন্তানঅর্থে। দেখা যাচ্ছে, ‘কিশোরশব্দটির বর্তমান অর্থে তেমন কিছু পরিবর্তন হয় নি। (তবে আজকের যুগধর্মের প্রকোপে কিশোর’-কুল কেন যে ইঁদুরদৌড়েসামিল হয়েছে, – তার সদুত্তর অবশ্য কোনও অভিধানে মিলবে না!)

অশ্ব = অশ্ + ব। অর্থাৎ অশ্বা প্রাপ্তি, উপভোগ, লাভ, ব্যাপ্তি, রাশীকরণ (রাশ করা, পুঞ্জীকরণ) ইত্যাদির ক্রিয়ার বহনকারী’ (ব)। সহজ করে বললে, ‘অশ্ববিশেষজ্ঞ ও উঁচু পদের কূটনীতিকগণ, -যারা বুদ্ধির জোরে কুটিল প্রদেশসমূহে অনায়াসে যাতায়াত করে। সে তার কৃতকর্মের আকার (আকৃতি) দ্বারা পরের ভীতি উৎপাদন করে। পরামর্শের মাধ্যমে চালকের (রাজার) প্রজ্ঞা বর্ধিত করে। সংঘাত বা কূটনীতির মাধ্যমে পররাজ্য গ্রাস করে, স্বরাজ্যের রাজকোষে ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত করে, রাজ্যের সীমা ব্যাপ্ত করে, ইত্যাদি। এই কর্মকাণ্ডকে অশ্বমেধ যজ্ঞবলে। আর যেহেতু ঘোড়ার মধ্যেও আতিভোজন, চলনপটুতা, ইত্যাদি গুণ দেখা যায়, তাই সেই প্রাণীকেও অশ্বনাম দেওয়া হয়।

আন্দাজ করা যায়, যেহেতু রোমান, আইরিশ ও নর্স (জার্মান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান) জাতিগুলির মধ্যে ঘোড়া বলি দেওয়ার ও তার মাংস ভক্ষণের প্রথা ছিল, তাই এই ইতিহাসে অভিজ্ঞ ইউরোপীয় পন্ডিতেরা অশ্বমেধ যজ্ঞ’-এর উল্লেখ পাওয়া মাত্র তাকে ঘোড়া বলিদাগিয়েছিলেন। আর এই ধারণায় সার-জল জুগিয়েছিল তাদের আর্য্য আগমন তত্ত্ব’! অশ্বমেধ প্রসঙ্গে অনেকে যজুর্বেদে অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনার কথাও তোলেন। কিন্তু, সেই মতে যজ্ঞের উপযুক্ত অশ্ব’-এর বয়স চব্বিশ থেকে একশ বছর! ঘোড়ার গড় আয়ু যেখানে কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর, সেখানে এই অশ্ব মানবপ্রজাতির তরুণ, প্রতিভাশালী অথবা অভিজ্ঞ কূটনীতিক, কোনও ভাবেই চারপেয়ে জন্তু নয়। এছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে, অশ্ব হল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। (রাজা সুশাসক হলে রাষ্ট্র বেগবান হয়, রাজকোষ ধনসম্পদে পূর্ণ হয়, তার আকার বা প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্য রাজাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে, পররাজ্য বিজিত হয়, ইত্যাদি। - নিরুক্ত অনুসারে যেগুলি অশ্বধর্ম।) এমন রাষ্ট্রের কামনায় বুদ্ধিনিষেক বা মেধাপ্রয়োগ করে যে কর্মযজ্ঞের আয়োজন করা হয়, তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞবলা হয়। (মেধথেকে মেধাশব্দটি সৃষ্টি হয়েছে।) ঘটনাচক্রে, ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তেই বলা হয়েছে, যজ্ঞ হল অহিংস। আর মেধশব্দটির অর্থ হত্যাহলে শুক্ল যজুর্বেদের মাধ্যন্দিন শাখার বাজসনেয়ী সংহিতায় যে সর্ব্বমেধ’, ‘পিতৃমেধ’, ‘পুরুষমেধ’, ইত্যদি যজ্ঞের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার স্বরূপ যে কী হত ভাবলেই শিহরণ জাগে!


মেধমানেই কিন্তু নিছক মাথা কেটে নেওয়ানয়। ঘটনাচক্রে, ‘উৎসর্গ করামানেও শুধু বলি দেওয়ানয়। মেধ্’-এর একটি অর্থ সঙ্গম। (প্রজায়ৈ গৃহমেধিনাম রঘুবংশ) সঙ্গম ভাবগত ভাবে একটি সৃষ্টিশীল ক্রিয়া। তাই মানুষের যে গুণ সর্বসাধারণের জন্য হিতকর বা তার সৃষ্টিশীলতার মেধ্এর আধার(আ)-কে মেধাবলা হয়। মেধমেধাদুটি শব্দই '√মেধ্ ধাতু থেকে সৃষ্টি হয়েছে (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ’ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। মেধ্ ধাতুর অর্থ মনে রাখা’ (সূত্র: ধাতু পারায়ণ’ – বন্দ্যোপাধ্যায়ি শ্রীযুক্ত লালকমল বিদ্যাভূষণ)।

No comments:

Post a Comment