ভদ্রতা

‘ভদ্র’ শব্দের বর্তমানে প্রচলিত অর্থগুলি হল অমায়িক, নম্র, সুপ্রতিষ্ঠিত, ইত্যাদি। কিন্তু মনুসংহিতা অনুযায়ী ‘যে গোপনে পাপ করে ও প্রকাশ্যে তা প্রচ্ছন্ন রেখে পর-ধন গ্রহণ করে, সে হল ভদ্র।’ –কি মারাত্মক কথা! এই সংজ্ঞায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আধুনিক ‘ভদ্রলোক’দের আসল চরিত্র ফুটে উঠলেও ‘ভদ্র’ শব্দটির প্রতি এ যে ঘোর অন্যায়! এখন এই ‘গোপন পাপে’র রহস্য নিষ্পত্তি করতে তন্ত্রশাস্ত্রে পৌছে দেখা গেল সেখানে ‘ভদ্র’ শব্দের অর্থ –‘চৌষট্টি কলায় পারদর্শী দক্ষ বা ভৃগুগণ’। -এ’ কি বাৎসায়নের কামসূত্রে বর্ণিত ৬৪ কলা? (শাস্ত্রকাররা কি ভদ্রলোকদের বিড়ম্বনার শেষ রাখেন নি!) দেখা যাক, এই কলাসমূহে কী পাওয়া যায়;-
কণ্ঠসংঙ্গীত, যন্ত্রসংঙ্গীত, নৃত্যকলা, অঙ্কন বিদ্যা, সীমন্ত/ কেশসজ্জা রীতি, কালভেদে রুচিভেদে ঋতুভেদে ও অবস্থাভেদে শয্যা প্রস্ত্তত প্রণালী, গৃহসজ্জা রীতি, অঙ্গরাগ (make-up) বিদ্যা, গৃহ নির্মাণ, রঙ্গরচনা, সন্তরণ ও জলক্রীড়া, চিত্রযোগে অপরের দৌর্ভাগ্যীকরণ বিদ্যা, পুষ্পালংকার প্রস্তুতি, সুগন্ধি প্রস্তুতি, বেশভুষা উদ্ভাবন, পরিচ্ছদ রচনা (tailoring), স্বর্ণকার বিদ্যা, আতিথিয়তা, জাদুবিদ্যা, হস্তলাঘব কর্মকুশলতা, রন্ধন, পানীয় ও মিষ্টান্নাদি প্রস্তুতি, তন্তুবায় বিদ্যা, সূচিশিল্প, বীণা-ডমরুক-বাদ্য তন্ত্রবিদ্যা, প্রহেলিকা রচনা, কাব্য রচনা, ভাষাতত্ত্ব, শ্লোক পাঠ, নাটক-অভিনয়-দর্শনের সমালোচনা, কাব্যের লুপ্ত পংক্তির পুনরুদ্ধার ও অনুলেখন, পট্টিকাবেত্রবয়ন (তৃণ/ বেত থেকে আসবাব রচনা), কুঁদনবিদ্যা (wood carving), তক্ষণ (carpentry), মণিভূমিকাকর্ম (jewel cutting/ polishing), রসায়ন ও ধাতু বিদ্যা, মৃৎশিল্প, উদ্যানপালন, পশুপালন, পক্ষীপালন, গাত্রমর্দন বিদ্যা, সংবাদ জ্ঞাপন ও প্রাপ্তি, সংকেতলিপি রচনা ও অর্থোদ্ধার (cryptography), অনুবাদ বিদ্যা, বাহন নির্মাণ ও পরিচর্যা, প্রতীকবিদ্যা, নানাবিধ যন্ত্রবিদ্যা, স্মৃতিশাস্ত্র বিদ্যা, পুস্তক পাঠ, পুস্তক রচনা, অভিধান ও বিশ্বকোষ বিদ্যা, ছন্দজ্ঞান ও বক্তৃতা বিদ্যা, ছদ্মবেশ বিদ্যা, দাবা ও পাশা খেলা, কুহক বা মোহিনী বিদ্যা, স্থলক্রীড়া বিদ্যা, ব্যায়ামবিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, মুখাকৃতির বিচারে চরিত্রনির্ণয়বিদ্যা (physiognomy), বার্ণিক (নকলনবিসি) বিদ্যা, মৃত্তিকা-ভাষ্কর্য এবং গণিত।...
দেখা যাচ্ছে, ‘যৌনশাস্ত্র’ হিসেবে পরিচিত হলেও কামসূত্রের এই চৌষট্টি কলায় ‘কামোত্তেজক’ (aphrodisiac অর্থে) বিশেষ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এ’গুলি বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখা বা ‘faculty’। অখণ্ড-জ্ঞান (ভারতীয় দর্শনে যার উৎসকে ‘পরম ব্রহ্ম’ বলা হয়) সীমাহীন। কোনও বাস্তব মানুষের সীমিত ক্ষমতার দ্বারা সেই অখণ্ড জ্ঞানের অসীমতার সম্পূর্ণ নাগাল পাওয়া অসম্ভব। জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাই অখণ্ড জ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলনের জন্য সাধ্যমত তাকে ৬৪ খণ্ড/ কলা/ বিদ্যা/ ধারায় (৬৪টি ‘specialised faculty’-তে) ভাগ করেছিল। বর্তমানে যা আরও specialised হতে হতে ৬৪০ বা ৬৪০০টি উপধারায় পরিণত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment