অধিকাংশ ভারতীয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্রাহ্মী
লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন, প্রিপ্রাবা লিপিটি একটি কৌটার উপর খোদিত ছিল।
কথিত আছে, সেই কৌটোটিতে নাকি বুদ্ধদেবের অস্থি ছিল। তার থেকে ধারণা করা হয় এ
লিপিটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৫০০ সময়কালের। মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপি ও
স্তম্ভ লিপিতে ব্রাহ্মীর অনেক পরিণত ও পূর্ণাঙ্গরূপ দেখা যায়। যা থেকে
ধারণা করা হয় বহুদিন ধরে দীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি অশোক
লিপির পর্যায়ে পরিণত হয়।
কুষাণ ও গুপ্ত যুগে প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপি পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং শেষ অবধি মোটামুটি তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মীর এই তিনটি ধারা থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্রাহ্মীর যে রূপটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘সারদা' লিপি। উত্তর ও মধ্য ভারতে যে ধারাটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘নাগরলিপি'/ ‘নাগরীলিপি’। পূর্ব ভারতে যে ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার নাম ‘কুটিল লিপি'। পণ্ডিতদের মতে, এই ‘কুটিল লিপি' থেকে আধুনিক বাংলা লিপির উদ্ভব। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত সমাচার দেবের (আনুমানিক ৫২৫-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তাম্র শাসনটি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন। পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপালের (দশম শতাব্দী) বাণগড় লিপিতে দেখা যায় যে এগারোটি বর্ণ আধুনিক বাংলা বর্ণের রূপ নিয়েছে।
অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝে বাংলার লিপিতে নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে এবং পূর্বভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে, যাকে ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি বলা হয়। (‘প্রোটো-’ শব্দের অর্থ ‘প্রায়-’) এই লিপি পরিবর্তনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের উদ্ভব। বাংলায় ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি খুব বেশি দিন চালু ছিল না। স্থানীয় লিপিকরদের কুটিল লিপির প্রভাবে এই ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রোটো-নাগরী ও কুটিল লিপির সম্মিলিত প্রভাবে বাংলা অঞ্চলের লিপি নতুন রূপ পায়, যাকে ‘প্রোটো-বাংলা’ বলা হয়। ঘটনাচক্রে, পালযুগের ‘অষ্টসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতা’ এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম্’ –এর পাণ্ডুলিপিগুলি প্রোটো-বাংলা লিপিতে রচিত।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেন, যাকে সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় কারণ, পিতা হেমন্ত সেনের প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র সেন রাজ্যকে তিনিই পরাক্রমশালী সম্রাজ্যে পরিনত করেন। এই বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ বিজয়ের পর বর্তমান রাজশাহী জেলার দেওপাড়ায় যে ‘বঙ্গাল প্রশস্তি’ স্থাপন করেন, তার প্রায় বাইশ-তেইশটি বর্ণের রূপ আধুনিক বাংলা লিপির মতো।
ত্রেয়োদশ শতাব্দীতে ‘বজ্রায়নেসাধনাঙ্গানি’, ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘গূহ্যাবলীবিবৃতি’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে আধুনিক বাংলা লিপির নিদর্শন পাওয়া গেলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত বড়ুচন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে বাংলা লিপি আরও পরিণত হয়। তবে উনবিংশ শতাব্দীতে ছাপাখানা চালু হওয়া ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার হওয়া অবধি স্থান-কাল বিশেষে বাংলালিপির কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটেই চলেছিল। আবার অনেকের মতে বাংলা লিপির উদ্ভব নাকি নাগরী লিপির সহোদর ‘সিদ্ধং/ সিদ্ধাম লিপি’ থেকে। সিদ্ধং শব্দের অর্থ "সম্পন্ন’ অথবা "নিখুঁত’। একদল পণ্ডিৎ সিদ্ধং (পরবর্তীকালে ‘সিদ্ধিমাতৃকা’) লিপিকে বাংলা ও অসমিয়ার পাশাপাশি ‘কানা লিপি’ (জাপানি ভাষা) ও তিব্বতি লিপির জননী মনে করেন। অনেকে আধুনিক বাংলা ও অসমিয়া লিপিকেও ‘সিদ্ধিমাতৃকা’ বা ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপি বলেন।
এদিকে চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশের সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জ অঞ্চলে আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির মিশ্রণে ‘সিলেটি নাগরী’ লিপির উদ্ভব ঘটে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ধর্মীয় পরিব্রাজক শাহ জালাল এই লিপি সিলেট অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন। শাহ জালাল ছিলেন সুফি সাধক আর সিলেটি নাগরী লিপিতে রচিত অধিকাংশ সাহিত্যকর্মে সুফিবাদের উপস্থিতি এই মতকে সমর্থন করে। অন্যদিকে ড. আহমদ হাসান দানীর মতো পণ্ডিৎবর্গের মতে, আফগান শাসনের সময় এই লিপির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ঘটনাচক্রে, সমসাময়িক আফগান মুদ্রায় উল্লেখিত লিপির সাথে সিলেটি নাগরীর কিছু বর্ণের সাদৃশ্য ছিল। এই লিপির অন্য নামগুলি হল জালালাবাদী নাগরী, ফুল নাগরী, মুসলমানী নাগরী, মোহাম্মদী নাগরী, ইত্যাদি। বর্তমানে এর কোনও ব্যবহার নেই বললেই চলে।
(কৃতজ্ঞতা: ‘The Origin of the Bengali Script’ – Rakhaldas Bandyopadhyay, ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ - Suniti Kumar Chatterji, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ –দীনেশচন্দ্র সেন, ‘বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর’ – অতুল সুর, ‘বাংলা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস’ - এস. এম. লুৎফর রহমান, ‘বর্ণমালার উদ্ভব বিকাশ ও লিপিসভ্যতার ইতিবৃত্ত’ - দেওয়ান গোলাম মোস্তফা, ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: শব্দের বিবর্তন বৈচিত্র্য’ - মনজুর রহমান, ‘বাংলা লিপির উৎপত্তি’ - সাইফুদ্দীন চৌধুরী, ইত্যাদি।)
কুষাণ ও গুপ্ত যুগে প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপি পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং শেষ অবধি মোটামুটি তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মীর এই তিনটি ধারা থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্রাহ্মীর যে রূপটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘সারদা' লিপি। উত্তর ও মধ্য ভারতে যে ধারাটি প্রচলিত হয়, তার নাম ‘নাগরলিপি'/ ‘নাগরীলিপি’। পূর্ব ভারতে যে ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তার নাম ‘কুটিল লিপি'। পণ্ডিতদের মতে, এই ‘কুটিল লিপি' থেকে আধুনিক বাংলা লিপির উদ্ভব। বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত সমাচার দেবের (আনুমানিক ৫২৫-৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তাম্র শাসনটি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন। পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপালের (দশম শতাব্দী) বাণগড় লিপিতে দেখা যায় যে এগারোটি বর্ণ আধুনিক বাংলা বর্ণের রূপ নিয়েছে।
অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝে বাংলার লিপিতে নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে এবং পূর্বভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে, যাকে ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি বলা হয়। (‘প্রোটো-’ শব্দের অর্থ ‘প্রায়-’) এই লিপি পরিবর্তনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের উদ্ভব। বাংলায় ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি খুব বেশি দিন চালু ছিল না। স্থানীয় লিপিকরদের কুটিল লিপির প্রভাবে এই ‘প্রোটো-নাগরী’ লিপি পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রোটো-নাগরী ও কুটিল লিপির সম্মিলিত প্রভাবে বাংলা অঞ্চলের লিপি নতুন রূপ পায়, যাকে ‘প্রোটো-বাংলা’ বলা হয়। ঘটনাচক্রে, পালযুগের ‘অষ্টসহস্রিকাপ্রজ্ঞাপারমিতা’ এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম্’ –এর পাণ্ডুলিপিগুলি প্রোটো-বাংলা লিপিতে রচিত।
দ্বাদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেন, যাকে সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় কারণ, পিতা হেমন্ত সেনের প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র সেন রাজ্যকে তিনিই পরাক্রমশালী সম্রাজ্যে পরিনত করেন। এই বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ বিজয়ের পর বর্তমান রাজশাহী জেলার দেওপাড়ায় যে ‘বঙ্গাল প্রশস্তি’ স্থাপন করেন, তার প্রায় বাইশ-তেইশটি বর্ণের রূপ আধুনিক বাংলা লিপির মতো।
ত্রেয়োদশ শতাব্দীতে ‘বজ্রায়নেসাধনাঙ্গানি’, ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘গূহ্যাবলীবিবৃতি’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে আধুনিক বাংলা লিপির নিদর্শন পাওয়া গেলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত বড়ুচন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত ‘বোধিচর্যাবতার’ প্রভৃতি পান্ডুলিপিতে বাংলা লিপি আরও পরিণত হয়। তবে উনবিংশ শতাব্দীতে ছাপাখানা চালু হওয়া ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার হওয়া অবধি স্থান-কাল বিশেষে বাংলালিপির কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটেই চলেছিল। আবার অনেকের মতে বাংলা লিপির উদ্ভব নাকি নাগরী লিপির সহোদর ‘সিদ্ধং/ সিদ্ধাম লিপি’ থেকে। সিদ্ধং শব্দের অর্থ "সম্পন্ন’ অথবা "নিখুঁত’। একদল পণ্ডিৎ সিদ্ধং (পরবর্তীকালে ‘সিদ্ধিমাতৃকা’) লিপিকে বাংলা ও অসমিয়ার পাশাপাশি ‘কানা লিপি’ (জাপানি ভাষা) ও তিব্বতি লিপির জননী মনে করেন। অনেকে আধুনিক বাংলা ও অসমিয়া লিপিকেও ‘সিদ্ধিমাতৃকা’ বা ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপি বলেন।
এদিকে চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশের সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কাছার ও করিমগঞ্জ অঞ্চলে আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির মিশ্রণে ‘সিলেটি নাগরী’ লিপির উদ্ভব ঘটে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ধর্মীয় পরিব্রাজক শাহ জালাল এই লিপি সিলেট অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন। শাহ জালাল ছিলেন সুফি সাধক আর সিলেটি নাগরী লিপিতে রচিত অধিকাংশ সাহিত্যকর্মে সুফিবাদের উপস্থিতি এই মতকে সমর্থন করে। অন্যদিকে ড. আহমদ হাসান দানীর মতো পণ্ডিৎবর্গের মতে, আফগান শাসনের সময় এই লিপির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ঘটনাচক্রে, সমসাময়িক আফগান মুদ্রায় উল্লেখিত লিপির সাথে সিলেটি নাগরীর কিছু বর্ণের সাদৃশ্য ছিল। এই লিপির অন্য নামগুলি হল জালালাবাদী নাগরী, ফুল নাগরী, মুসলমানী নাগরী, মোহাম্মদী নাগরী, ইত্যাদি। বর্তমানে এর কোনও ব্যবহার নেই বললেই চলে।
(কৃতজ্ঞতা: ‘The Origin of the Bengali Script’ – Rakhaldas Bandyopadhyay, ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ - Suniti Kumar Chatterji, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ –দীনেশচন্দ্র সেন, ‘বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর’ – অতুল সুর, ‘বাংলা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস’ - এস. এম. লুৎফর রহমান, ‘বর্ণমালার উদ্ভব বিকাশ ও লিপিসভ্যতার ইতিবৃত্ত’ - দেওয়ান গোলাম মোস্তফা, ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্য: শব্দের বিবর্তন বৈচিত্র্য’ - মনজুর রহমান, ‘বাংলা লিপির উৎপত্তি’ - সাইফুদ্দীন চৌধুরী, ইত্যাদি।)
No comments:
Post a Comment