সুকুমার রায় তার ‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘ভাষা যে নিজের
অর্থ গৌরবেই সত্য, একথা ভুলিয়া সে যখন কেবলমাত্র শব্দগৌরবে বড় হইতে চায়,
তাহার অত্যাচার অনিবার্য।’... একটু ভাল করে চোখ খুললে সত্যি-ই কি এই
অত্যাচার চোখে পড়ে না? তাবড় তাবড় (প্রকৃত) পণ্ডিতরা বলে গেছেন, –মানুষের
ভাষা তার চিন্তাপদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। সেখানে ভাষা অত্যাচারী হয়ে উঠলে
চিন্তা যে পালাই-পালাই রব তুলবে –সে আর অবাক কথা কি! শব্দার্থের আকালে ভাষা
জড়ভরত, ফলে চিন্তা থেকে-ও নেই। এদিকে, ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে কোনও একটা খামতি দেখা গেলেই আওয়াজ তুলি, -‘স্পোকেন ইংলিশ উইক্’ অথবা ‘প্রতিবাদের ভাষা নেই’।
(হয়তো ছোট মুখে বড়ো কথা হয়ে যাচ্ছে, তবে না বলা অন্যায়) মঙ্গলচণ্ডী,
মঙ্গলকোট বা মঙ্গলযান, –যে পথের-ই পথিক হই না কেন, ভাষায় কমতি মানে সবই
ভাসা-ভাসা! ফলে ‘জাতীয়তাবাদী’, ‘জাতীয়তাবিরোধী’, ‘বিপ্লবী’, ‘সংশয়বাদী’,
‘সুবিধাবাদী’-এর মতো কিছু বাজারগরম শব্দকে চারপাশে উড়তে দেখে সাতে পাঁচে না
থাকতে চাওয়া আমরা আতঙ্কে ছুটে বেড়াই। -ঠিক ভেড়ার পালে বাঘ পড়লে যেমন হয়।
-এই বুঝি কোনও একটি শব্দ ‘৬৯-এর ঙ’ হয়ে পিঠের ওপর দেগে গেল! (অনেক সময় আবার
উপযাচক হয়েও নিজেকে দাগাতে চাই।)
‘প’ হল পালন, ‘ল’ হল লালন, ‘ব’ হল বহন; এই পালন, লালন, বহন নিয়ে ‘প্লব’; প্লব থেকে প্লবতা; প্লবতার বিশেষ/ বিপরীত ভাব হল ‘বিপ্লব’। -নিজের ভেতরে এই বোধ থাকলে বিপ্লবের বাজারচলতি সংজ্ঞা আওড়াতে হয় না।
শব্দের ভিতরেই থাকে তার অর্থের ইঙ্গিত। অথচ, কোন এক রহস্যময় কর্তৃপক্ষ অলক্ষ্যে বসে সেই অর্থ দেয় গুলিয়ে, -শুধু শব্দের-ই নয়, জীবনের-ও! ফলে ‘যোগ’ শব্দটি অংক খাতার পাতা থেকে উঠে শরীরে বসতে না বসতেই ওতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ লেগে যায়, ‘যোগী’ শব্দের অনুরণনে ‘ভণ্ড’-শব্দটি আপনা থেকেই কানে বাজতে থাকে। কিন্তু, ‘প্রতিযোগিতা’-কে মেনে নিই জীবনের মূল ধর্ম্ম হিসেবে! ‘competition’-এর ‘com’ যে ‘সমবেত’ আর ‘petition’ যে ‘প্রার্থনা/ আবেদন’ –তা কোন কুটুমে খেয়াল রাখে! (বিশ্বাস না হলে, ব্যুৎপত্তি যাচাই করে দেখা যেতে পারে; শিল্পবিপ্লবের আগে অবধি ‘competition’-শব্দটির অর্থ এমন-ই ছিল।)
আসলে, ওই দাগানোয় ব্যস্ত ‘বিচারক’ বা ‘দাগী’, দু’জন-ই শব্দকে শুধু ব্যবহার করে। -হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ বিধান করার মতো। কেউ-ই অর্থ ভেবে দেখে না। ফলে, অপরাধী জানেই না সে কেন শাস্তি পায়, জল্লাদ-ও বোঝে না সে কেন হাতল টানে! দেখে কেউ কেউ কিছুক্ষণ চেঁচায়, বাকিরা ‘কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে’ বোঝাতে চায়, ‘কেন এ-সব কথা, এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ ক’রে থাকা।’... তারপর একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আমার-ই মুখের ভাষা আমার বোধের জন্য শিকল আর জীবনের জন্য পাগলা-গারদ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
‘প’ হল পালন, ‘ল’ হল লালন, ‘ব’ হল বহন; এই পালন, লালন, বহন নিয়ে ‘প্লব’; প্লব থেকে প্লবতা; প্লবতার বিশেষ/ বিপরীত ভাব হল ‘বিপ্লব’। -নিজের ভেতরে এই বোধ থাকলে বিপ্লবের বাজারচলতি সংজ্ঞা আওড়াতে হয় না।
শব্দের ভিতরেই থাকে তার অর্থের ইঙ্গিত। অথচ, কোন এক রহস্যময় কর্তৃপক্ষ অলক্ষ্যে বসে সেই অর্থ দেয় গুলিয়ে, -শুধু শব্দের-ই নয়, জীবনের-ও! ফলে ‘যোগ’ শব্দটি অংক খাতার পাতা থেকে উঠে শরীরে বসতে না বসতেই ওতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ লেগে যায়, ‘যোগী’ শব্দের অনুরণনে ‘ভণ্ড’-শব্দটি আপনা থেকেই কানে বাজতে থাকে। কিন্তু, ‘প্রতিযোগিতা’-কে মেনে নিই জীবনের মূল ধর্ম্ম হিসেবে! ‘competition’-এর ‘com’ যে ‘সমবেত’ আর ‘petition’ যে ‘প্রার্থনা/ আবেদন’ –তা কোন কুটুমে খেয়াল রাখে! (বিশ্বাস না হলে, ব্যুৎপত্তি যাচাই করে দেখা যেতে পারে; শিল্পবিপ্লবের আগে অবধি ‘competition’-শব্দটির অর্থ এমন-ই ছিল।)
আসলে, ওই দাগানোয় ব্যস্ত ‘বিচারক’ বা ‘দাগী’, দু’জন-ই শব্দকে শুধু ব্যবহার করে। -হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ বিধান করার মতো। কেউ-ই অর্থ ভেবে দেখে না। ফলে, অপরাধী জানেই না সে কেন শাস্তি পায়, জল্লাদ-ও বোঝে না সে কেন হাতল টানে! দেখে কেউ কেউ কিছুক্ষণ চেঁচায়, বাকিরা ‘কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে’ বোঝাতে চায়, ‘কেন এ-সব কথা, এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ ক’রে থাকা।’... তারপর একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আমার-ই মুখের ভাষা আমার বোধের জন্য শিকল আর জীবনের জন্য পাগলা-গারদ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
No comments:
Post a Comment