পৌরাণিক ‘ঘরওয়াপ্‌সি’


হিন্দুধর্মে এত জাতবিচার, শূদ্র বা দলিতদের প্রতি এত অবিচারের জন্য হামেশাই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যগুলিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু, সেটা কতদূর ঠিক? দেখা যাক;-

• ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। পূর্বে ব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পূর্ণ ছিল। তারা ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিযুক্ত বা প্রযুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র নামে অভিহিত হয়েছে। (মহাভারত শান্তিপর্ব, ১২.১৮৬.১০)
• পূর্বে ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পূর্ণ ছিল। তারাই বিভিন্ন পেশায় (কর্মে) নিযুক্ত হলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, ইত্যাদি বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। ‘তস্মাদ্বর্ণা ঋজবো জ্ঞাতিবর্ণাঃ’ – সমস্ত বর্ণই একে অপরের জ্ঞাতি। (শান্তিপর্ব ১৮৮-১০।)
• দেব, মুনি, দ্বিজ (দৈহিক জন্মের পর জ্ঞান অর্জন হেতু যার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে), রাজা (ক্ষত্রিয়?), বৈশ্য, শূদ্র, নিষাদ, পশু (‘যে অবিশেষে দেখে’, ত্রিসন্ধ্যাজপ ইত্যাদি পালন করে), ম্লেচ্ছ ও চাণ্ডাল (চণ্ডাল হইতে জাত) – এই দশ প্রকার ব্রাহ্মণ হয়। (৩৬৪ নং সূত্র, অত্রি সংহিতা।)
• অথর্ব্ব বেদে প্রার্থনা করা হয়েছে, -হে মানবজাতি, তোমাদের জলগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ একসাথে হো’ক। (অথর্ব্ববেদ ৩.৩০.৬)
• আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র অনুসারে, আর্য্যাদের তত্ত্বাবধানে শূদ্রের রান্না করাই নিয়ম। (আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ২.২.৩.৪)
আসলে বৌদ্ধযুগের পতনের পর বৈদিকধর্মের ব্যাপক restructuring করে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সৃষ্টি করার সময় বৈদিকধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বাদ দিয়ে, জন্মগত জাতিভেদ প্রথা চালু করে সামাজিক hegemony-কে পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। -যাতে সমাজের শৃঙ্খলাটা বেশ কড়া হাতে ধরে রেখে সম্ভাব্য কোনও ‘দ্বিতীয় বৌদ্ধযুগে’র আগমণ ঠেকানো যায়।

হ্যাঁ, বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের আক্রোশ কিছুটা বেশিই ছিল। নারদপুরাণে বলা হয়েছে, নিজের চরমতম বিপদের দিনেও যদি ব্রাহ্মণ কোনও বৌদ্ধের বাড়িতে প্রবেশ করে, তাহলে কয়েক শো বার প্রায়শ্চিত্তেও তার নিস্তার নেই। (নারদ পুরাণ ১.১.১৫.৫০) এই পরিমাণ ভয় দেখিয়েও যখন শেষরক্ষা হল না, তখন গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর ‘নবম অবতার’ হিসেব প্রচার শুরু হয়েছিল!

মহাভারতের শল্যপর্বে একটি অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কোনও এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় সারস্বত মুনির নেতৃত্বে গোমতী নদীর তীরে অন্নসত্র খুলে, খাদ্যের ‘বিনিময়ে’ প্রায় ষাট থেকে চৌষট্টি হাজার বৌদ্ধকে বেদপাঠ শুনিয়ে, পৈতে পরিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল।

মহাভারতে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে। কিন্তু, অতিপ্রাচীনকালে রচিত বলে একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও মহাভারত ‘লেখা’ হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ, মৌর্য্যযুগে। (সূত্র: ‘সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ’ – পরেশচন্দ্র মজুমদার) ঘটনাচক্রে, মহাভারতের ভাষাতেও অভিজাত সংস্কৃতের পরিবর্তে প্রাকৃত ও ‘মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃত’ ভাষার প্রভাব বেশি। অবশ্য মহাভারতের অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্করণগুলিতে এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’র ঘটনাটি বৌদ্ধদের পরিবর্তে ‘বেদজ্ঞান বিস্মৃত’দের সাথে ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু মহাভারত নয়, ভবিষ্যপুরাণেও এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’ বা ধর্মান্তকরণের উল্লেখ আছে। এই পুরাণটির রচনাকাল ষষ্ট শতাব্দীর প্রথমভাগের আগে নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে ‘মরুস্থলে’ (মেরুস্থলে বা মেরুপ্রদেশে নয়) ‘মহামদ’ (মহম্মদ?) নামের এক ‘শিষ্যশাখা’ (সাহাবি?) সহ বিরাজ করার কথা বা মরুস্থলের রাজা ও নিবাসীরা সেই মহাদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার কথা বলা আছে। (ভবিষ্যপুরাণ, ৩.৩.৩.৫-৬। যদিও গোরক্ষপুর গীতাপ্রেসের ভবিষ্যপুরাণের হিন্দি অনুবাদে এই শ্লোকদুটির উল্লেখ থাকলেও তাদেরকে অনেকটাই ‘ভিন্নার্থে’ ব্যখ্যা করা হয়েছে।)
যাই হোক, ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে মহর্ষি কর্ণের চেষ্টায় ‘মিশ্রদেশ’ বা মিশর থেকে উদ্ভূত কশ্যপগোত্রের ‘ম্লেচ্ছ’রাও বেদ পাঠ, শিখা ও উপবিত ধারণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যধর্মে পুনঃপ্রবেশ করে। (ভবিষ্যপুরাণ, প্রতিসর্গ ৪.২১)।

ওপরের অনুচ্ছেদটি পড়ে দুটি খটকা জাগতে পারে। এক, ম্লেচ্ছদের ‘কশ্যপ গোত্র’ বলা হচ্ছে কেন? ও দুই, ‘মিশ্রদেশ’কে ‘মিশর’ ভেবে বসা কতটা যুক্তিযুক্ত?

প্রথমতঃ, ম্লেচ্ছ শব্দের বর্তমান অর্থ যাই হোক না কেন, যাবতীয় শূদ্র ও ‘অব্যক্তভাষী’ (যে সংস্কৃতে কথা বলে না) মানুষকেই ম্লেচ্ছ বলা হত। হরিবংশপুরাণ ও মনুসংহিতা অনুসারে ‘বদাচারবহিষ্কৃত’ ও মেদিনীকোষ অনুসারে ‘বেদবাহ্য দুরাচার’ মাত্রেই ম্লেচ্ছ। আর কে জানে, শূদ্রেরই বেদপাঠ নিষিদ্ধ ছিল। আর ‘শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে’র ‘প্রাণতোষী’ অধ্যায়ের ‘হর-পার্বতী সংবাদ’ অংশ অনুসারে শূদ্রজনের গোত্র হল কশ্যপ।

(এই ‘হর-পার্বতী’র কথোপকথনের মাধ্যমে দেশের পঁচাশি শতাংশ মানুষের গোত্র পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার ঘটনা থেকেই ‘হরে দরে কশ্যপ গোত্র’ –প্রবাদটির উৎস। অবশ্য কশ্যপগোত্রের মানুষজন বহুক্ষেত্রেই মানসম্মান কম পেয়েছেন, কশ্যপপত্নী সরমার প্রিয়পাত্রদের বা ‘সারমেয়’দের তো কুকুরের সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়!)

রইল পড়ে ‘মিশ্রদেশ’ রহস্য। সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলাভাষায় মিশরকেই মিশ্রদেশ বলা হত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯০৯ সালে প্রকাশিত সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ভারতে অলিকসন্দর’ (আলেকজ়ান্ডার) নামক বইয়ের একটি অংশে দেখা যায়, সেখানে আলেকজ়ান্ডার বলছেন, ‘...ফিনিসীয় নৌশক্তির সাহায্যে, আমরা সামুদ্রিক আধিপত্য লাভ করিতে সমর্থ হইব। তখন মিশ্রদেশ অধিকার আমাদের সহজসাধ্য হইবে। মিশ্রদেশ বিজয়ের পর গ্রীসের বা আমাদের দেশের ভাবনা আর ভাবিতে হইবে না।...’

যাই হোক, ঘরওয়াপ্‌সি-তে ‘ওয়াপ্‌স’ আসা যাক। এই বিষয়ে সমস্ত উদ্যোগকে ছাপিয়ে গিয়ে ছিল আদি শঙ্করাচার্য্য। আনন্দগিরির ‘শঙ্করদিগ্বিজয়’, চিদ্ধিলাস যতির ‘শঙ্করবিজয়’, ব্রহ্মানন্দের ‘লবুশঙ্করবিজয়’, তিরুমল্প দীক্ষিতের ‘শঙ্করাচ্যুদয়’, ইত্যাদি গ্রন্থের কিংবদন্তি অনুসারে অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারত, মধ্যভারত ও দাক্ষ্যিণাত্যে কয়েক কোটিরও বেশি ‘বিকৃত’ বৌদ্ধকে ব্রাহ্মণ্যধর্মে ফিরিয়ে আনেন! তবে বাংলা সহ পূর্বভারতে এর প্রভাব তেমনভাবে পড়ে নি। শশাঙ্কের শাসনকালে (৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের আনাগোনা শুরু হলেও আঠারো পুরুষ ধরে চলা পাল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় বৌদ্ধধর্ম টিকে ছিল বহাল তবিয়তেই। বরং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মে ‘যৌথ প্রভাবে’ তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ (যাঁরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ক্ষত্রিয়ের পেশা গ্রহণ করেন) সেন রাজবংশের আমলে বৌদ্ধ, তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মিলেমিশে এক ‘পৃথক হিন্দুধর্মে’র সৃষ্টি হয়। (হয়তো সেই কারণেই আজও বাঙালি হিন্দু ও উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে আচার আচরণে বেশ কিছু তফাৎ থেকেই গিয়েছে।) কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে কৌলিণ্যপ্রথা ও বিভিন্ন রাজ অনুগ্রহের কারণে যে সেনবংশের দৌলতে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, পশুপতি মিশ্র নামের এক ব্রাহ্মণই এগারো লক্ষ টাকার ঘুষের বিনিময়ে বখতিয়ার খলজীর হতে সেনবংশের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেনযুগের পর সুলতানি শাসনকালে বাংলার ‘মুণ্ডিতমস্তক’ (ন্যাড়া) বৌদ্ধদের অপরাংশ পরিণত হয় ‘নেড়ে মুসলমানে’।

No comments:

Post a Comment