সোমরস বা বণিকপুঁজি

ঋগ্বেদে কয়েকশো (হাজার-ও হতে পারে) বার প্রভুত্বকারী বা ইন্দ্র-সত্তার সোমরস-প্রেমের কথা বা তাকে সোমরস উৎসর্গ করার নির্দেশ পাওয়া যায়। (‘সোম’ শব্দের একটি অর্থ ‘চন্দ্র’) সোমরস মাদকতা আনে। প্রভুত্বকারীর মাদকতা কিসে হয়? –প্রভুত্বে বা ব্যক্তিমালিকানায়। (ইন্দ্র বিরোধী জরাথুস্ট্রীয়রা ‘হাওমা’ বা সোম-পানের বিরোধী।) বেদে ‘সোম’ সোমরস। কিন্তু, বাণিজ্যতন্ত্রের যুগে ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের সাথে সাথে এই সোম ‘চন্দ্রদেবতা’ হিসেবে উল্লেখিত হতে থাকেন। চন্দ্রের ষোলটি কলা। দেখা যাক কী কী ;-
• অমৃতা : অমরত্ব দানকারী ‘অমৃতে’র ‘আধার’ (আ)। মনুসংহিতা অনুসারে যজ্ঞশেষের পুরোডাশ বা পিঠে (কর্মযজ্ঞের ফলে উৎপন্ন পণ্য), ধন, ঘৃত, অন্ন, বিষমাত্র, সুরা, অতিবিষ, ইত্যাদি। (বণিকের নাম ‘অমরত্ব’ পায় তার পণ্য, সম্পদ, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, brand name-এর মাধ্যমে।)
• মানদা : মান দান করে যা/ যে। কৌলীন্য, পরিমাপ, গোঁসা/ গুমোর, ইত্যাদি দান করে যা/ যে।
• পূষা : ‘পূষ’-এর (প্রদানকারীর দিশাগ্রস্ত শক্তির) আধার (আ)। (‘পূষ’ থেকে ‘পোষণ’ বা আধুনিক ‘পোষা’) ধনসম্পদ বা জ্ঞানসম্পদের কেন্দ্র।
• তুষ্টি : সন্তোষ বা প্রীতির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• পুষ্টি : সম্পূর্ণতা, সন্তুষ্টি, পূর্ণতা, ইত্যাদির সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• রতি : রত + ই (সক্রিয়ন)। কর্মে নিযুক্ত/ লিপ্ত/ অর্পিত (invested) বা ‘রত’ হওয়া। (স্মর্তব্য: আরতি, বিরতি, অবিরত, কর্মরত, ইত্যাদি শব্দগুলি।)
• ধৃতি : সুখ, আশ্রয়, শরণ, ব্যভিচারভাব বিশেষ। মানসিকতার বন্দিত্বের (ধৃত) সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• শশিনী : ‘শশ-গুণ’ বা দ্রুত/ আকস্মিক/ (লাফিয়ে লাফিয়ে) আকার বৃদ্ধির/ হ্রাসের গুণ সক্রিয় যা’তে। (‘শশক বা খরগোশের চিহ্ন বুকে ধারণ করে বলে চাঁদের আরেক নাম শশধর’, -এই জবরদস্তি ব্যাখ্যাটি আধুনিক যুগের সংযোজন। চাঁদের পিঠে আলো-ছায়ার খেলাকে শুধু খরগোশ কেন, আরও অনেক কিছুর-ই আবয়ব হিসেবে কল্পনা করা যায়। আশৈশব ‘চাঁদের বুড়ি’র গল্প শোনানোর পর, একমাত্র এই ‘শশধর’ শব্দটির ন্যায্যতা ‘প্রমাণ’ করার সময় সেই বুড়ি হঠাৎ খরগোশে পরিণত হয়!)
• চন্দ্রিকা : আনন্দদায়িনী, বিশদব্যাখ্যা, ইত্যাদি।
• কান্তি : ‘কান্ত’ (কাম তাড়িত হয় যা’তে বা যা’কে সবাই কামনা করে) –এর সক্রিয়তা (ই) যা’তে।
• জ্যোৎস্না : জ্যোতির্যুক্ত কাল। নিজস্ব নয়, ‘-জনিত’ বা প্রতিফলিত আলো।
• শ্রী : অভ্যুদয়, বৃদ্ধি, উদয়, ঐশ্বর্য্য, প্রভুভাব, অধিকার, ইত্যাদির প্রকাশ।
• প্রীতি : তৃপ্তি, আমোদ, প্রেমভাব, ইত্যাদির প্রকাশ।
• অক্ষদা : ‘অক্ষ’ দান করে যা/ যে। অক্ষ = যা ব্যাপ্ত করে।
• পূর্ণা : ‘পূর্ণ’ (আরক্তি, সামগ্রিকতা, আকর্ষণ, ইত্যাদি) -এর আধার (আ)।
• পূর্ণামৃতা : পূর্ণ + অমৃতা, বা ‘অমৃতা’-কলার পূর্ণ রূপ/ ভাব।
একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চন্দ্রের ষোলটি কলা ব্যক্তি-পুঁজির বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট-বাচক। উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে মধ্যবিত্তের আতঙ্ক উদ্রেককারী শব্দ ‘চাঁদা’ -এর দিকে খেয়াল করলেই ব্যক্তি-পুঁজির সাথে ‘চাঁদে’র সম্পর্ক হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যায়! বহুক্ষেত্রেই এই অনুষ্ঠানগুলি সম্পন্ন করা হয় ‘চন্দ্রাতপ’ বা ‘চাঁদোয়া’র তলায়। [চন্দ্র > চন্দা > চাঁদ। অবশ্য অনেকের মত বাংলাভাষায় ‘চাঁদা’ শব্দটি এসেছে ফার্সি ‘চন্দহ্’ শব্দ থেকে। হতেই পারে। কারণ, আবেস্তান (প্রাচীন ফার্সি) ও বৈদিক ছান্দস ভাষা নিকটাত্মীয়।] পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের আতপ বা রৌদ্র থাকে না। এই প্রথার তাৎপর্য হল –ব্যক্তি পুঁজির ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। যাই হোক, আদিতে এই ব্যক্তি-পুঁজির কারবারীরা নিজের নামে ‘চাঁদ’ বা ‘চন্দ্র’ শব্দগুলি প্রয়োগ করত। (স্মর্তব্য: ‘চাঁদ সদাগর’ নামটি।) ‘প্রচলিত প্রথার বিপরীতে চললে’ বা ‘বামন’ হলে ব্যক্তি-পুঁজির বা বণিক-পুঁজির নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু, শেয়াল/ শিয়াল/ শৃগাল অপরের শিকার বা পরিশ্রম লব্ধ ফল অপহরণ করতে অভ্যস্ত। (সম্ভবতঃ ‘মাখন চুরি’ ও কূটবুদ্ধির কারণে) পৌরাণিক ভাষায় স্বয়ং বাসুদেবকেই শৃগাল বলা হয়েছে! (সূত্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ, সারস্বতাভিধান, শব্দকল্পদ্রুম) শৃগাল ফিরে ফিরে চুরি করে। স্বভাববশতঃ, সে ‘চাঁদ উঠলে’ (ব্যক্তি/ বণিক পুঁজির উদয় হলে) হাঁকডাক শুরু করে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্যক্তি পুঁজিকেই বণিক পুঁজি বলা হচ্ছে কেন? –পুঁজির উৎসের কারণে। বিক্রয়যোগ্য বিষয়টি ‘পণ্য’ই হোক কি ‘শ্রম’ অথবা ‘মেধা’, পুঁজি উপার্জনের সময় কোনও না কোনও রূপে যে কর্মটি সম্পাদন হচ্ছে তা হল বাণিজ্য। এমনকি আজও যার শ্রম আছে -সে শ্রম বিক্রি করে, যার মেধা আছে -সে বিক্রি করে মেধা আর বাকিরা বিক্রি করে এই দুই পক্ষের শ্রম ও মেধার প্রয়োগে উৎপাদিত পণ্য।
(প্রসঙ্গতঃ বলি, পুঁজ ও পুঁজি, -শব্দদুটির উৎস একই। চাষীর ভাগের ধান জোতদার বা জমিদারের খামারে জমে থাকলে তাকে ‘পুঁজ’ বলা হয়। ১৯৪৬-৪৭-এর তেভাগা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ছিল ‘পুঁজ ভাঙা আন্দোলন’।)

No comments:

Post a Comment