‘জঘন্য’

একটি খাজা সিনেমা দেখার পর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল একটি শব্দ, -‘জঘন্য’। তারপর, বেজায় সমস্যায় পড়া গেল সেটিকে নিয়ে। এই তৎসম শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘জঘনভব’ বা ‘জঘনতুল্য’ {জঘন + য (যৎ)}। কিন্তু, এই অর্থ শেষ অবধি ‘নিকৃষ্ট’/ ‘নিন্দনীয়’ বা ‘কুৎসিত’-এ দাঁড়াল কেন, -সে এক রহস্য! ‘জঘন’ শব্দটি বেদে ব্যবহৃত। -‘আ জঙ্ঘন্তি সান্বেষাং জঘনাঁ উপজিঘ্নতে। অশ্বাজনি প্রচেতসোহশ্বান্ সমৎসু চোদয়॥’ (ঋগ্বেদ ৬.৭৫.১৩) –এর অর্থ হল বুদ্ধিমান অশ্বের (প্রচেতসঃ অশ্বান্) জঘন প্রদেশে পুনঃ পুনঃ আঘাত করে (উপজিঘ্নতে) তাকে যুদ্ধে (সমৎসু) নিযুক্ত/ প্রেরণ (চোদয়) কর।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য যে ‘নিযুক্ত করা’ বা ‘প্রেরণ করা’ অর্থে ব্যবহৃত ‘চোদয়’ শব্দটি এসেছে ‘√চুদ’ ধাতু থেকে। শব্দটি বর্তমান রূপ আধুনিক বাংলাভাষায় ইতর শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বিচার করলে বোঝা যায় সেখানেও মূল/ আদি অর্থ আসলে অপরিবর্তিতই রয়েছে। ঘটনাচক্রে, সভ্যজনের দ্বারা আপাতনিন্দিত শব্দটি কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্রেও উপস্থিত, -‘...ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ॥’ (ঋগ্বেদ, ৩.৬২.১০)।...
যাই হোক, বোঝা গেল যে বৈদিক (ছান্দস) ভাষায় ‘জঘন’ শব্দটির একটি অর্থ ‘কটিদেশ’। এরপর পঞ্চতন্ত্রে পাওয়া গেল ‘...পরমসুখং জঘনচপলায়াঃ’, অর্থাৎ কিনা ‘জঘন’ হল (নারীদেহের) নিতম্ব-পরিসর। (ইঙ্গিত বুঝে বাৎসায়ন, দামোদর গুপ্ত, জয়দেব, প্রমুখের রচনা আপাতত বাদ দেওয়া হল, কারণ সেখানে অন্য কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।) এরপর ধর্মমঙ্গল কাব্যেও শব্দটির অর্থের তেমন কিছু পরিবর্তন হয় নি (‘জঘনে জঘনে যুগ্ম বদনে বদন। নাগর নাগরী কোলে নিদ্রায় মগন॥’)। তাহলে যে জঘন ‘পরমসুখং’ বা ‘চপলায়াঃ’, তার ‘-তুল্যতা’ নিন্দনীয় হবে কেন?
উত্তর মিলল মনুসংহিতায়। এই আইনগ্রন্থটিতে নারীর স্থান কহতব্য নয়। ইহলোকে পুরুষকে দূষিত করা নাকি নারীদের স্বভাব (‘স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম্‌’)!... রূপ বা বয়সের কোনও বাছবিচার না করে পুরুষ পেলেই নারী তাকে ভোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে (‘নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্হিতিঃ। সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে’)!... এমনকি, নিজের মা বোন বা মেয়ের সাথেও নাকি সেই কারণে একা থাকতে নেই (‘মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ’)!... আর না এগোনোই ভাল। যাই হোক, যে শাস্ত্রকারগণ নারী সম্বন্ধে এমন ‘উচ্চ’ ধারণা পোষণ করতেন, নারীর অঙ্গবিশেষের প্রতি তাদের (অন্ততঃ লোকদেখানো) দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হবে –তা বলাই বাহুল্য! কিন্তু, তারা এখানেই থেমে থাকলেন না। বললেন, ‘উত্তমমাং সেবামানস্তু জঘন্যো বধমর্হতি।’ (৮.৩৬৬) অর্থাৎ, উচ্চবর্ণের কন্যাগমনকরী শুদ্র বধ্য বা বধযোগ্য হবে। ‘জঘন্য’ শব্দের অর্থ এখানে ‘শুদ্র’। আর শুদ্র মানেই তো হীন নীচ, সুতরাং-। একটি মাত্র শব্দের মাধ্যমে প্রথমে নারীজাতি, তারপর ভূখণ্ডের পনেরো আনা মানুষকেই তারা নিকৃষ্ট, নিন্দনীয় বলে দাগিয়ে দিলেন! কে জানে এমন কত অন্যায়ের উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি আমাদের ভাষায়। ভাগ্যিস, সমস্ত শব্দের ব্যুৎপত্তি জানা নেই!...

No comments:

Post a Comment